হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় নজরুল

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সুমন দাস
আমাদের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে নতুন করে লিখবার কিছুই নেই। অথবা আমার মতো ক্ষীণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাকে নিয়ে ভাবার স্পর্ধা কোথায়; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন আলোচনার অন্তরালে যে হীনম্মন্যতা উঠে আসে, তা নজরুল আদর্শের অন্তরায়। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, একজন সাহিত্যিক কোনো গোষ্ঠীবাদ বা সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধ নন, যেমন ধরুন একজন ভ্রমণকারীর, সাধ্যমতো সর্বত্রই বিচরণ স্বাভাবিক, এক স্থানে বসবাস ভ্রমণের শর্তবিরোধী তদরুপ ভ্রমর মধু আহরণে সব ফুলেই বসে থাকে। তাই একজন কবির সীমাবদ্ধতা শুধু তার সাহিত্য জগতে আর সমস্ত ক্ষীণকায় সদা উপেক্ষিত। অতএব, কোনো সাহিত্যিককে নিয়ে নিজের স্বাধীন মন্তব্য প্রকাশের পূর্বে সাহিত্যিকের সাহিত্যকে স্বাধীন রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়। সাহিত্যর ভূমির এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে এই বিচরণকারীর আজও রেখাপাত অঙ্কুরিত হয়নি। তার সাহিত্য ছিল একদম ভিন্ন ধরনের, যা তার নিজস্ব ধারা বলেই পরিচিত এবং অন্য কারও সাহিত্য কর্মের সঙ্গে কোনোরূপ সাদৃশ্য নেই বা থাকতে পারে না। রাবেন্দ্রিক ঢং ও নাজরুলিক আঙ্গিক সম্পূর্ণই ভিন্নতর। যারা চর্চা করেন তারা অবশ্যই সহজেই বুঝতে পারবেন। তাই রবীন্দ্র ও নজরুল সমালোচকদের একটা কথাই বলতে চাই। অন্যের যদি কিছু মালিন্যতা থেকেই থাকে, তা নিজে মুখে তুলে নেবেন না। এ অত্যন্ত হীন প্রবৃত্তি। নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাজারের মোতোয়ালি। সে সুবাদে মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি সুমধুর সুরে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে শিখেছিলেন। তার এই ধর্মের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে রচনা করলেন ইসলামিক চিন্তাচেতনা এবং আদর্শিক কবিতা, হামদ নাত, গজল- যা ইসলামিক রচনাবলির মধ্যে খ্যাত। অন্য দিকে হিন্দু শাস্ত্রে সে ছিলেন বিরল পন্ডিত, রচনা করেছেন ভক্তিমূলক গান, যা আজ অবধি অদ্বিতীয়। তিনি একাধারে ছিলেন প্রেমের কবি, প্রেমিক কবি, প্রেম যেন তার ধমনিকে করেছিল শান্ত ধীরস্থির। অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন একেবারে সূর্যসৈনিক। কলমকে যেন অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। রচনা করেছিলেন 'বিদ্রোহী'র মতো কালজয়ী কবিতা। তার জন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়েছিল। এমন দৃষ্টান্ত আর নেই যেন। জ্ঞান তাকে করেছিল সংকীর্ণতা মুক্ত, সীমাহীন, চির অমর। কিন্তু ইদানীং কিছু রবীন্দ্র ও নজরুল ভক্ত সম্প্রদায়ের মোড়কে আবদ্ধ করে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন, তা সত্যিই লজ্জাজনক। এর সুন্দর সমাধান দুরূহ। অবশ্য একটা কথা বলতে পারি যদি মৃত ব্যক্তির আত্মা হাজির করার কোনো উপায় থাকত তবে এই বিতার্কিকদের ঘাড় মটকিয়ে দিতেন বাংলাসাহিত্যের এ দুই দিকপাল। কেননা, নজরুল ছিলেন একেবারেই রবীন্দ্রভক্ত আর রবীন্দ্রনাথও নজরুলের প্রতি ছিলেন স্নেহবৎসল। স্নেহ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তারা ছিলেন গুরু-শিষ্য, নজরুল কিছু রচনা করলে যেমন রবীন্দ্রনাথকে না শোনালে স্বস্তি পেতেন না। অন্যদিকে কোনো কবি বৈঠকে নজরুলের জন্য রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা করতেন শেষ অবধি। এমনটা দেখে বোঝা ভার যে তাদের বয়সে প্রায় ঊনচলিস্নশ বছরের ব্যবধান। একটি ঘটনা পড়বার সুযোগ হয়েছিল- একবার এলাকার এক ক্লাবের যুবকরা রবীন্দ্রনাথের কাছে বায়না করল যে তারা নাটক করবে সে নাটক তার লিখে দিতে হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছেলেদের পরামর্শ দিলেন নাটকটা নজরুলের কাছ থেকে লিখে নিতে। কিন্তু মুশকিল হলো নজরুল অনেকটা ক্ষ্যাপাটে। নিজের মনমর্জি ছাড়া কিছুই করেন না। কেউ বললেই যে তাকে নাটক লিখে দিতে হবে এমনটা নয়। সে বুদ্ধিও বাতলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ শিখিয়ে দিলেন নজরুলকে গিয়ে খবর দেবে যে আপনার একটি গানের পাতা ক্লাব ঘরে পড়ে আছে। এই শুনে যখন নজরুল হন্তদন্ত হয়ে ক্লাব ঘরে ঢুকবে তখন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নাটক লিখতে বাধ্য করা হবে। যে কথা সেই কাজ সবকিছু ঠিকঠাক মতোই হলো। নজরুল লিখেও দিলেন নাটকটি, পরে দরজা খুলে দেয়া হলো নজরুল চলে গেলেন। কিন্তু নাটকটি দেখে ছেলেদের চোখ ছানাবড়া- কারণ নাটকটি ফারসি ভাষায় রচিত উপায়ন্ত না পেয়ে লেখাটি নিয়ে যাওয়া হলো কবিগুরুর কাছে। রবীন্দ্রনাথ হেসেছিলেন আর স্নেহের স্বরে বললেন 'এ আমার ক্ষ্যাপা নজরুল' শেষে অতি যত্নে রবীন্দ্রনাথ নাটকটি বাংলায় সংকোলন করে দেন। নাটকটি মঞ্চায়িত হওয়ার পর রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে সংবর্ধিত করেছিলেন। এই হলো তাদের সম্পর্কের অপূর্ব দৃষ্টান্ত; কিন্তু এখন যারা অপব্যাখ্যা ও সমালোচনা করছেন, করছেন মিথ্যাচার এ তাদের হীনম্মন্যতা ও সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবতা হলো বাংলা সাহিত্য ভুবনে উদিত তপন রূপ রবীন্দ্রনাথ আর সে রবির বিস্তৃত আলোক রশ্মি হচ্ছেন কবি নজরুল। পরিশেষে বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপাল চিরকাল বাংলার হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবেন। সদস্য সচিব জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম কাহালু উপজেলা।