বৃষ্টিভেজা পদ্মফুল

প্রকাশ | ০৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

মো. ওবায়দুল হক
যৌবনা বষার্র প্রকৃতির কোমল দঁাত খেয়ে যাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের মুখের হাসি। কয়েকদিন যাবৎ লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণের বারিধারায় তিতাসের শান্তজলে তলিয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। দাবা, লুডু খেলে সময় কাটছে সবার। আমি অনীতা, তানহা, খাটে বসে লডু খেলছি। বৃদ্ধ দাদিমা পেছনের জানালা খুলে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, ‘ইসলাম, ইসলাম, দ্যাইখা যা, সাপে ব্যাঙ ধরছে!’ আমরা খেলা রেখে তিনজন গা ঘেঁষাঘেষি করে জানালার কাছে দঁাড়ালাম। সাপের মুখে অসহায় ব্যাঙের বেঁচে থাকার আকুতিতে যেন কঁাপাচ্ছিল বষার্র বাদল দিন। যেখানে সবাই মজা উপভোগ করছে, সেখানে অনীতা মায়াময় কণ্ঠে বলল, ‘সাপের মুখ থেকে ব্যাঙটা বঁাচিয়ে দেন না। ভগবান আপনার মঙ্গল করবে...।’ আমি অনীতার দিকে বড়চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘পাগলে পাইছে ত আমারে!’ ‘প্লিজ। দেখুন না চেষ্টা করে। আহা হা রে, ব্যাঙটা কীভাবে কাতরাচ্ছে!’ সাপটার তুলনায় ব্যাঙটা একটু বড়। তাই ব্যাঙটাকে পরাস্ত করতে সাপটা হিমশিম খাচ্ছে। সাপটাকে জোরে আঘাত করলাম বঁাশের লাঠি দিয়ে। ব্যাঙটাকে ছেড়ে দিয়ে সাপটা জলডাঙায় গড়াগড়ি করছে। ব্যাঙটা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যেতে লাগল। এদিকে অনীতার মুখে সূযের্র জ্যোতিমির্য় হাসি! অনীতা হাসি থামিয়ে বলতে থেকে আরে তাকিয়ে আছেন কেন, ‘মারেন, সাপটাকে মারেন, নইলে রাতে এসে আপনাকে কামড়াবে!’ আমি সাপটাকে মেরে ফেললাম। গ্রিলের এপাশ থেকে অনীতার দিকে তাকিয়ে বলাম, ‘এবার খুশিত?’ আন্দঘন পৃথিবীটা যেন আমার চোখে সামনে একটা প্রাণীকে বঁাচিয়ে দেয়ার আনন্দে লাফাচ্ছে। বলল, ‘হে আমি অনেক হ্যাপি আমার অনেক দিন মনে থাকবে।’ ‘তুমি খেয়াল করেছো, ব্যাঙটাকে বঁাচাতে গিয়ে সাপটাকে মেরে ফেলতে হলো। দুটোই কিন্তু প্রাণী?’ এবার অনীতার হাসিউজ্জ্বল মুখটায় মুহূতের্র মধ্যই অমাবস্যার রূপ নিল। ফ্যাকাসে মুখের অনুতপ্ত কণ্ঠে, বলল, ‘তাতো ঠিক বলছেন। আমি তো এভাবে খেয়াল করিনি।’ আমি অনীতার মুখে স্পষ্ট দেখত পেলাম পবিত্র মানুষে ফেরস্তাময়ী রূপ। আমি বললাম, ‘যদি আরেকটু অন্যভাবে বলি, তাহলে সাপটাকে মেরে ফেলাই ঠিক হয়েছে।’ ‘যেমন?’ ‘ব্যাঙতো ক্ষতি করে না, সাপ তো মানুষকে ছোবল দেয়! এ জায়গা থেকে সাপটাকে মেরে ফেলাই উত্তম না?’ আমার কথাটা শুনে ফের যেন ঊষার রবি উদয় হলো মায়াবীনীর মুখে আমি অপলকে তাকিয়ে আছি অনীতার দিকে, আজ কত বছর পর এ হাসি দেখলাম! অনীতাদের আসা এ যেন আমার জীবনের সমস্ত রূপকথাকে হার মানিয়েছে। কখনো ভাবিনি ওর সাথে দেখা হবে। আমাদের পাশের অংশটাই অনীতাদের ছিল। একে একে সবাই যখন দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া পারি জমাতে শুরু করল, তখন অনীতার বাবাও চলে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। তার পথের বাধা হয়ে দঁাড়ান অনীতার বৃদ্ধ দাদা। তার এককথা, ‘এ দেশে আমার জন্ম। স্বাধীনতা যুদ্ধে রক্ত দিয়েছি! এ দেশ আমার। আমি এ দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার মরার পর যেখানে খুশি চলে যেও।’ তাই বাধ্য হয়ে বাবার মৃত্যু অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যখন ওরা দেশ ছেড়ে যায়, তখন অনীতা ক্লাস সেভেন আর আমি এইটে পড়তাম। অনীতাদের চলে যাওয়া আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছিল। আমার অনেক ভালো লাগত অনীতাকে। রাতে শুয়ে শুয়ে ওকে ভাবতাম। জানি না সেই বয়সের ভালোলাগা, রাত জাগাগুলোকে কী বলে। আজও আমার ভালো লাগার আকাশটাতে অনীতাই রয়ে গেল। ২. পঁাচদিন পর। আজকে বিকেলে সূযর্টার উঁকি দিল। পশ্চিম আকাশে সেজেছে রংধনুর সাত রঙে। বাদল ধোয়া গাছপালা নদী যেন লাগাতার বষের্ণর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে নীরবতা পালন করছে। জলপাটিতে সন্ধ্যার লালচে আকাশ শুয়ে আছে মায়ের কোলের ঘুমন্ত শিশুর মতো আমরা সবাই আমাদের ছাদে প্রকৃতির অবয়ব আলিঙ্গনে মুখরিত। অনীতা মমতাময়ী তিতাস নদীটার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে। ‘কী দেখছ এভাবে?’ ‘নদীটাকে। আমার শৈশবের তিতাস নদীটা। প্রিয় নদীর বুকে কত ভেসেছি আমরা দলবেঁধে।’ আহ! কতদিন পর এ গঁায়ে। প্রায় একযুগ পর এখানে। যে শিকড়ের পথেঘাটে, নদীতে আমি নামের অনীতার কত স্মৃতি, কত হাসি কান্না জড়িয়ে। ‘আচ্ছা ইসলাম ভাই, স্কুলের পেছনের বড় কদম গাছটা কি এখনো আছে? ’ ‘ওই পুরনো গাছটা এখন নেই, তবে কদম গাছ আছে। বড় গাছটা কেটে বেশ কয়েকটা নতুন গাছ লাগানো হয়েছিল।’ ‘আপনার মনে আছে, ওই গাছ থেকে পড়ে আপনার হাত ভেঙেছিল। আমার জন্য কদমফুল আনতে গিয়ে!’ আমি মাথা ঝুকে বোঝালাম, ‘মনে আছে।’ ‘আপনি কিন্তু ভাঙা হাত নিয়ে অনেক কষ্ট করেছিলেন। বেশ কয়েকদিন স্কুলেও যেতে পারেননি।’ ‘বাহ! তুমি তো দেখছি সব মনে রেখেছ।’ দেখুন, বাল্যকালের কিছু কিছু স্মৃতি, সারাজীবন তাড়া করে।’ ‘যাবে নাকি স্কুলের ওদিকে?’ ‘চলেন যাই, ঘুরে আসি।’ তানহা, আমি, অনীতা খালি পায়ে গ্রামের অঁাকাবঁাকা কাদাভরা মেঠোপথে পা টিপেটিপে চলছি। এক সময় নয়াপাড়ার ব্রিজের আসতেই অনীতা বলল, ‘আরে এখানে তো বঁাশের সঁাকো ছিল।’ ‘হ্যা, এখানে বঁাশের সঁাকো ছিল, প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে, আমি তোমার স্কুল ব্যাগটা পার করে দিতাম।’ আমার কথা শুনে গালে ভঁাজ তুলে হাসলো সন্ধাদেবী। যথাসময়ে আমরা স্কুল মাঠে চলে এলাম। অনীতা মন ভরে আশপাশ দেখছে। সব কিছু পালটে গেছে, একদম চেনা যাচ্ছে না। আমরা যখন পড়তাম তখনতো স্কুলটা টিনের ঘর ছিল। এখন তিনতলা বিল্ডিং! সামনের জায়গাটা অনেক নিচু ছিল স্কুল থেকে। আপনারা ক্রিকেট খেলতেন এখানে। আর আমরা মেয়েরা বারান্দায় দঁাডিয়ে খেলা উপভোগ করতাম। আহ! কি মধুময় ছিল দিনগুলো? খুব মনে পড়ে। গল্প করতে করতে চলে এলাম কদম গাছের তলে। আমি লাফ মেরে কদম গাছে উঠতে থাকি. আর অনীতা আমাকে ডেকে বলল, ‘দেখবেন আগের মতো পরে হাত পা ভাঙবেন না যেন!’ এই বলে গাছের উপরের আমাকে মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দি করছে। বুঝতে পারলাম বতর্মানের জনপ্রিয় অসুখ, সেলফি রোগ, ওর মাঝেও আছে! আমি বেশ কয়েকটা কদম ফুল নিয়ে গাছ থেকে নেমে এলাম, অনীতা উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল, দেন, আমাকে দেন, কদম ফুল আমার অনেক পছন্দ!’ ফুলগুলো অনীতার হাতে ছেড়ে দিলাম। ফ্যাল ফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছি, অনীতার দিকে। অনীতা ফুলগুলো থেকে একটি ফুল পাতাসহ তানহার চুলের খেঁাপায় গুঁজে দিল। তানহাও একটি ফুল গুঁজে দিল অনীতার খেঁাপায়। আর আমার সরল ইচ্ছেটার জীবন্ত মৃত্যু হচ্ছে ওদের ফুল গুঁজাগুঁজির খেলায় অনীতাকে এখানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যই ছিল, নিজ হাতে অনীতার চুলের খেঁাপায় বষার্র কদম ফুল গুঁজে দেব বলে। সদস্য জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম ঢাকা