একটি দীর্ঘশ্বাসের গল্প

প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
পাঁচ বছর হলো ফরহাদ তালুকদার অধ্যাপনার চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসরের পর তার দিনগুলো কাটছে একরকম নিঃসঙ্গভাবে। জীবনের এক পরাবাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি। অবশ্য জীবন চলার পথে কত শত বাস্তবতার মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই; কিন্তু ইদানীং কেন যেন তার ভার সইতে পারছেন না তিনি। আজ শরতের এই চাঁদটা আলো দিচ্ছে অকৃপণভাবে, তার আলো ঠিকরে পড়ছে ডালপালার ফাঁক দিয়ে। শরতের মাঝামাঝি সময়টার প্রকৃতিতে হালকা কুয়াশা নেমে আসে। ভিজিয়ে দিয়ে যায় মাটির ওপর সবুজ গালিচার মতো জেগে থাকা দূর্বাঘাসগুলো। হালকা কুয়াশা দূর্বাঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু সঞ্চায়িত করলেও চাঁদ কিন্তু ঠিকই হাসছে। ফরহাদ তালুকদার এতক্ষণ পূর্বপাশের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে দুলছিলেন। এবার তিনি গ্রিল ধরে আরো গভীরভাবে তাকালেন আকাশ পানে, যেখানে চাঁদ মনের আপন মাধুরী দিয়ে বিলাচ্ছে তার আলো। গ্রিলের ওপারে শিউলি ফুলের গন্ধ নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। প্রকৃতির এমন মায়াবী দৃশ্যে একরাশ স্মৃতির জাল তাকে জড়িয়ে ধরছে অক্টোপাসের মতো। হৃদয়ের সাঁটানো ক্যানভাসে ভেসে উঠছে ধারণকৃত কতগুলো ছবি, যে ছবিগুলো আজও জীবন্ত, প্রাণবন্ত। হয়তো এ ছবিগুলি জীবন্ত রবে যতদিন নাসিকারন্ধে চলবে শ্বাস-প্রশ্বাস। মনে পড়ে, এমনি এক ঝলমলে আলোকময় রাতে শেফালীকে তিনি বউ করে ঘরে আনেন। মহা ধুমধামের সঙ্গে বরণ করে নেয়া হয় নববধূকে। সেদিন এই আলিশান বাসা ছিল না, তারস্থলে ছিল একটি ছোট্ট টিনের ঘর কিন্তু সেই ছোট্ট ঘরখানি শত-সহস্র ভালোবাসায় ভরপুর ছিল। কুঁড়ে ঘরের যে কক্ষটিতে ফরহাদ-শেফালীর বাসর হয়েছিল, সেই কক্ষটির পূর্ব দিকে একটি খিড়কি ছিল। শরতের স্নিগ্ধ আলো খিড়কি দিয়ে সে রাতে উপচে পড়েছিল সারা কক্ষময়। সেই ক্ষণে শরতের ঝলমলে চাঁদের আলো শেফালীর রূপ-সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে। শেফালীর লাজুক হাসি দেখে ফিক করে হেসেছিল আকাশের চাঁদ। হয়তোবা নববধূর রাঙ্গা মুখখানি দেখার মানসে রাতের চাঁদ আকাশ হতে নেমে এসেছিল বেশ কাছে। তাই ঐ চাঁদকে মনে হয়েছিল পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও বিশাল, যেমনটি আজ দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে চাঁদ নয়, একটি পূর্ণ কাসার পেস্নট ভাসছে আকাশে। সারা আকাশ জুড়ে কোথাও মেঘের লেশমাত্রটিও নেই। মনে পড়ে, ফরহাদ-শেফালীর চার চোখের দুষ্টামিতে চাঁদ হেসেছিল মুখটিপে। কিন্তু আজ সেই চাঁদে কোনো দুষ্টামি নেই, নেই কোনো চঞ্চলতা, আছে কেবল একরাশ হতাশা আর অসম্ভব এক সরলতা। শরতের এই চাঁদও জেনে গেছে, বিয়ের ১০ বছর যেতে না যেতেই সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে, সব ভালোবাসাকে পেছনে ফেলে অর্পা ও অনন্যাকে পৃথিবীর জমিনে রেখে, শেফালী চলে গেছে না ফেরার দেশে। বাম পাঁজরের হাড় খসে পড়ায় সেদিন মূর্ছে পড়েছিলেন ফরহাদ তালুকদার, অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন তিনি কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি, শক্ত করে হাল ধরেন দক্ষ নাবিকের মতো। ফরহাদ তালুকদারের শুভাকাঙ্ক্ষিরা তাকে অনেক পীড়াপীড়ি করেছে দ্বিতীয় বিয়ে করতে কিন্তু ফরহাদ তালুকদার তার হৃদয়কে ভাগ করতে চাননি, ভালো করতে চাননি হৃদয়ের জমায়িত শীতল ভালোবাসাকে। তিনি আর বিয়ে করেননি। দু দুটি মেয়েকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়। তিনি কখনো সেজেছেন বাবা, আবার কখনো মা। মেয়ে দুটিকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি এতটুকু। তাদের বড় করেছেন মায়ের মমতা ও বাবার স্নেহ দিয়ে। \হবড় মেয়ে অর্পা এখন স্বামী সন্তান নিয়ে আমেরিকায় থাকে। ছোট মেয়ে অনন্যার স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। সেও এখন চট্টগ্রাম থাকে। মেয়েরা বহুবার বলেছে, বাবা তুমি চলে এসো কিন্তু তালুকদার নিজ গ্রামের মায়া ত্যাগ করে যেতে রাজি হয়নি। এই গ্রাম, এই গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো তাকে একান্ত আপনজন করে নিয়েছে। এ গ্রামের শ্যামল প্রকৃতি, সবুজ ধান গাছের শীষ বেয়ে আসা শীতল হাওয়া, কোকিলের সুরেলা কুহু তান, পত্র পলস্নবের প্রাণ উদাস করা মর্মর ধ্বনি, তাকে সর্বদা বিমোহিত করে রেখেছে এতদিন; কিন্তু অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন কখনো কখনো নিজেকে একা মনে হয়, বড্ড একা। পাহাড়সম রিক্ততা তাকে অস্থির করে তুলে। যে সময় তার চারপাশে থাকার কথা গুটিকয়েক নাতি-নাতনি, যাদের কোলাহলে ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা, সেখানে আজ তার চারদিকে কেবলই নিঝুম নিস্তব্ধ নীরবতা। এক অজানা মানসিক একাকিত্ব তাকে ঘুমাতে দেয় না। এ যেন নিজ গৃহে নিজ বৃদ্ধাশ্রম। জমিরউদ্দিনের ডাকে ঘোর কাটে ফরহাদ তালুকদারের। 'চাচাজান, চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল।' ফরহাদ তালুকদার চোখের কোণে চিকচিক করে উঠে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছেন তিনি। ফিরে এসে চেয়ারে বসেন। গরম চায়ের কাপে চুমুক দেয়। এক অস্থিরতা নিয়ে ডানে-বামে তাকান। মনে মনে বলেন, 'এ ঘরখানি কুঁড়ে ঘর থেকে প্রাসাদে রূপ নিয়েছে, ঘরের পরিধি বেড়েছে বিস্তর, প্রতিটি রুমেরও বেড়েছে পরিধি। কিন্তু ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, মায়া-মমতার পরিধি বাড়েনি এতটুকু বরং হয়েছে উল্টো। সংকোচিত।' \হতিনি টেবিলে কাপ রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, 'বুঝলে জমির, প্রতিটি মানুষই শেষ বেলাতে প্রকৃতির কাছে অসহায়। মানুষ এ প্রকৃতির হাতের পুতুল যেন। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে যেভাবে খেলতে চায়, মানুষকে ঠিক সেভাবে খেলতে হয়। আসলে খেলার নামে সে এক অভিনয়। অভিনয়ের খেলাও এক সময় শেষ হয়। তখন পড়ে থাকে শুধু একাকিত্ব, শুধু নিঃসঙ্গতা।' ফরহাদ তালুকদার চেয়ারে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করেন। হয়তো অপরিমেয় অবসাধ তাকে আবারও ঘিরে ধরেছে, হয়তো এক রাশ শূন্যতা তাকে আবারও ঘ্রাস করেছে। তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। দীর্ঘশ্বাসের তোড়ে তার ঠোঁট দুটি লাফায় অনরবত। সদস্য, জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম \হময়মনসিংহ।