চড়াই পাখির সংসার

প্রকাশ | ২৮ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আমাদের চৌচালা টিনের ঘরের বারান্দার পাকনার চালের এক পাশে এক জোড়া চড়াই পাখি বাসা বেঁধেছে। সারাদিন তারা বাসানিমাের্ণর কাজে ব্যস্ত থাকে। বাসায় তাদের আসা-যাওয়া আবার যাওয়া- আসায় কোনো বাধা-বিপত্তি নেই। বারান্দা দিয়ে আমাদের চলাফেরা তারা ভ্রক্ষেপ করে না। সারাদিন কিচির-মিচির শব্দ আর জঙ্গল এনে বাসা তৈরি, যেন তাদের সারাদিন বিরাম নেই। ওদের কোনো বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন ওদের কাছে এলেও যেন কথা বলার সুযোগ নেই, এমনই ব্যস্ততা। আমাদের মুরগির খাবারের সঙ্গে ওরাও খাওয়া-দাওয়ার কাজটি সেরে নিচ্ছে প্রতিদিন। বাড়িতে যখনই সময় পাই তখনই দুটি পাখির জীবনযাত্রা সম্পকের্ লক্ষ্য করি। ওরা বেশ ভালো আছে। ওদের বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, বাসা থেকে বারান্দায় পরা জঙ্গল পরিষ্কার করতে হয় না। এ সবের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ ওদের কাছে মোটেও পাত্তা নেই। ওরা মনের সুখে ঘর বঁাধা নিয়ে ব্যস্ত সারাদিন। একদিন সকাল বেলা ঘরের দরজা খুলেই দেখা গেল চড়াই পাখির অসংখ্য পালক বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। সহজেই বুঝতে পারলাম ঘরের বাসিন্দারা শত্রæদ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এসব দেখে আমরা শোকাহত হলাম। ভাবলাম দু’জনেই বুঝি শেষ হয়েছে। কে এমন কাজ করতে পারে তা আমরা বুঝে ওঠতে পারলাম না। ক্ষাণিক পরে দেখি পুরুষ চড়াই পাখিটি বারান্দার গ্রিলে নীরবে বসে আছে। সাথী হারানোর বেদনা যেন মমের্ মমের্ অনুভব করছে। কোনো সারা-শব্দ নেই। আমরা সমবেদনা প্রকাশ করলাম। তার পরে তিন-চার দিন পাখিটির আর দেখা নেই। হঠাৎ দেখা গেল পাখিটি আবার বাসায় ফিরে এসেছে। আমরা খুশি হলাম এবং একা একা তার ভালো লাগছে না সেটাও বুঝতে পারলাম। সাথীকে হারিয়ে যেন শোকে পাথর হয়ে গেছে। বারান্দার গ্রিলে একা একা বসে থাকে কোনো কথা বলে না। আবার থেকে থেকে কোথায় চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর পর ফিরে আসে। পরমাসুন্দরী ও সবর্ক্ষণের ভালো-মন্দের সাথী হারিয়ে সে বড়ই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। একদিন সকাল বেলা আমরা বারান্দা দিয়ে হঁাটছি। এমন সময় আমাদের সেই পাখিটি একটি স্ত্রী চড়াই পাখি নিয়ে এসে হাজির। বারান্দার গ্রিলে বসে কিচির মিচির করে পাখিটিকে তার সংসার করার প্রস্তাব দিচ্ছে। স্ত্রী পাখিটি কিচির মিচির করে নতুন সংসার করার ইচ্ছা জানিয়ে দিচ্ছে। পুরুষ পাখিটি দু’পাখা মেলে নববধূকে আনন্দে বরণ করে নিচ্ছে। ঠিক এমন সময় পালিয়ে আসা পাখিটির স্বামী পিছে পিছে এসে হাজির। এসেই আমাদের পাখিকে আক্রমণ। তীব্র থেকে তীব্রতর আক্রমণ। কোনোভাবেই যুদ্ধ প্রতিহত করা যাচ্ছে না। যুদ্ধ চলল। তার স্ত্রীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসা এ যেন ভীষণ অন্যায়। রাগ ক্ষোভ ও যুদ্ধের তীব্রতা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে বাংলার বার ভ‚ঁইয়ার একজন ইশা খঁার সঙ্গে যুদ্ধ। আমরা উভয়পক্ষের নীরব সেনাদের মতো দঁাড়িয়ে রইলাম। এ দিকে ছেড়ে আসা স্বামী ও হবু স্বামীর প্রচÐ যুদ্ধ দেখে স্ত্রী চড়াই বড়ই দিশেহারা হয়ে কিচির-মিচির শুরু করে দিয়েছে। একদিকে নিজের স্ত্রীকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার চরম রাগ অপরদিকে স্ত্রীহারা পাখির নতুন করে ঘর বঁাধার স্বপ্ন যেন দুটি কারণ একত্র হয়ে যুদ্ধ বেঁধেছে। নিজের স্ত্রী অন্যের হাত ধরে চলে যাওয়া এ যেন সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া। তাই মান-মযার্দার লড়াই। পরের স্ত্রীকে প্রেমের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসার চরম প্রতিশোধ নেয়া যেন বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাই এ যুদ্ধে তাকে জিততেই হবে, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেই হবে। তাই তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধ ক্ষেত্র ঘন ঘন পরিবতর্ন হতে থাকল। কারও কোনো ছাড় নেই। এমন অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা দেখে আমাদের পুরুষ পাখির হবু স্ত্রী নতুন স্বামীর মায়া ত্যাগ করে, নব সংসারের আশা ভঙ্গ করে পুরনো স্বামীকে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়ে নিজ বাসভবনের উদ্দেশ্যে আমাদের বাড়ি ত্যাগ করল। কিšুÍ যুদ্ধ অমীমাংসিত রয়ে গেল। জয়-পরাজয়ের ইতিহাস আর রচিত হলো না। সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহ ইশা খঁার সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েও হারেননি আবার আমাদের স্বাধীন বাংলার সাহসী সৈনিক বীর রাজা ইশা খঁা যুদ্ধে জিতেও হেরে গেলেন সম্রাট আকবরের রাজদরবারে যেয়ে। যদিও এ যুদ্ধে এমনটি ঘটেনি। তবে ওদের প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। তবে আমাদের পাখিটি অপর পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র অমীমাংসিত অবস্থায় ত্যাগ করা মেনে নিতে পারেনি। তাই তার মনের অবস্থা বার বার কিচির মিচির করে জানাতে ছিল। অন্যের স্ত্রীকে ভাগিয়ে এনে নতুন করে ঘর সংসার করার চেষ্টা এবারের মতো ব্যথর্ হলো। একা একা দিনরাত কয়েকদিন কাটতে থাকল। প্রতিদিন সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে যায় আবার বিকেলে বাসায় ফিরে। সারাদিন কোথায় থাকে তা আমাদের উদ্ধার করা অসম্ভব। বাসায় প্রবেশের পূবের্ গ্রিলে নীরবে বসে থাকে। শোকাহত চেহারা দেখে আমাদের আর ভালো লাগতেছিল না। কিন্তুÍ আশার কথা হলো এমন অবস্থায় বেশিদিন থাকতে হলো না। একদিন সকাল বেলা পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনে বেশ আগ্রহ ভরে বারান্দায় বের হয়ে দেখলাম, কোথা থেকে কার স্ত্রী আবার ভাগিয়ে নিয়ে এসে তার সঙ্গে ঘর বঁাধার আয়োজন করছে। কনে যেন নিজে এসেই বরের বাড়ি ঘর দেখছে। মনে হলো বাড়ি ঘর কনের পছন্দ হয়েছে। নতুন বরের সঙ্গে ঘর বঁাধার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। এমনি পরিবেশে পাখি তার পুরনো স্ত্রীর কথা ভুলে গিয়ে নতুন স্ত্রীকে কাছে পেয়ে যেন আনন্দে মেতে উঠেছে। বিয়ের ধুম-ধাম দেখে আমরা আনন্দিত হলাম। এবার কিন্তু ভাগিয়ে আনা স্ত্রীর স্বামী পিছে পিছে ছুটে আসেনি। জানি না সে তার প্রাক্তন স্বামীকে ছাড়াছাড়ির কাগজপত্র দিয়ে এসেছে কি-না। তবে দু’জনে অতীত সম্পূণর্ ভুলে গিয়ে নতুন সংসার গড়ার কাজে বেশ মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই। আর তা হচ্ছে নববধূ তার সতীনের সন্তান লালন পালন করবে না। বাসায় দুটি ডিম ছিল। তা ছিল সতীনের। স্বামী তার নববধূর সঙ্গে একমত প্রকাশ করে সতীনের দেয়া ডিম ঠেঁাট দিয়ে বাসা থেকে বের করে এনে আমাদের পাকা বারান্দায় ফেলে দিল। সতীনের হবু সন্তানরা এমনি করে সৎ মায়ের কাছে নীরবে নিমর্মভাবে নিহত হলো। আবার মেতে উঠল নতুন করে বাসা বঁাধার, নতুন করে সংসার করার। প্রকৃতি যেন এমনি এক নিষ্ঠুরতার ও ভালোবাসার অনন্ত দুনিয়া। যগ্ম আহŸায়ক যায়যায়দিন ফ্রেন্ডস ফোরাম নাগরপুর, টাঙ্গাইল