নাটক-সিনেমার আদালত ও বাস্তবতা!

নাটক-সিনেমায় আদালতের দৃশ্য দশর্কদের মধ্যে বাড়তি রোমাঞ্চ তৈরি করে। কিন্তু সেখানে আদালতের যে দৃশ্য দেখানো হয় কিংবা বিচারক ও আইনজীবীদের যেসব সংলাপ বলতে দেখা যায়, বাস্তবের আদালতের সঙ্গে তার অনেক কিছুরই মিল নেই। এমনকি নাটক-সিনেমার আদালতে কখনো কখনো এমন সব ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা আদালত অবমাননার পযাের্য় পড়ে। সাধারণ দশর্ক এসব দেখে আদালত সম্পকের্ ভুল বাতার্ পাচ্ছেন।

প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মতিউর রহমান ফয়সাল
‘আদালত’ নামে একটি টিভি সিরিয়াল হয় ভারতীয় সনি ৮ চ্যানেলে, যাতে বাংলাদেশের দশের্কর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়
নাটক সিনেমায় যে আদালতব্যবস্থা বা বিচারক অথবা উকিলদের চরিত্র দেখানো হয় তার সঙ্গে বাস্তবের মিল কদাচিৎ। এসব চরিত্র লেখন ও অভিনয়ে কখনো কখনো রচয়িতা বা পরিচালকের গুরুতর অজ্ঞতা প্রকাশ পায়। আইনি দৃষ্টিতে চরিত্রগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অথবা কাজের ধরন বা ব্যবস্থাটা এবং যে আইনটির প্রকাশ করা হচ্ছে তা সূ²ভাবে জেনে নেয়া উচিত। কদিন আগে একজন রাগত স্বরে অভিযোগ করল, স্যার, টিভিতে সিনেমায় দেখি মামলা একদিনেই শেষ হয়ে যায় আর আমার মামলা ২ বছর হয়ে গেছে কিছুই হয় না! বললাম, মামলাটা টিভির নাটক সিনেমার পরিচালককে দিয়ে করান তা হলেই হবে। বাস্তব আর টিভি এক নয়। টিভিতে শুধু যুক্তিতকর্ আর সাক্ষী দেখানো হয়, কিন্তু বাস্তবে দেওয়ানি মামলার স্তর ১২টি। ফৌজদারি মামলায় স্তর সাধারণত ৮টি। এসব পার হয়ে একটা মামলা শেষ করা হয়। অনেক বন্ধু বা পরিচিতজন আদালতে আসেন কীভাবে বিচার কাজ হয়, আমরা কীভাবে কী করি তা দেখার জন্য। দেখার পর হতাশ হয়ে বলেন, ‘টিভির সঙ্গে তো কিছুই মেলে নাই জজ আর উকিল ছাড়া!’ ‘আদালত’ নামে একটি টিভি সিরিয়াল হয় ভারতীয় সনি ৮ চ্যানেলে, যাতে বাংলাদেশের দশের্কর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। সিরিয়ালে অনেক কাল্পনিক মামলা সমাধান করেন উকিল কে ডি পাঠক। চঁাদের দেশের খুন নিয়ে জেরা করছেন আর সত্য বের করছেন অসাদৃশ্য আদালতের বিচারপদ্ধতি আর সাক্ষী জেরার কল্পনাবিলাসিতার মাধ্যমে! সাক্ষীর কোনটা জবানবন্দি, কোনটা জেরা, আর কোনটা যুক্তিতকর্ কিছুই সুনিদির্ষ্ট না তাতে। বিভিন্ন পবের্ অযৌক্তিক, অকল্পনীয় বিষয় টিভির পদার্য় দেখানো হয়। যার সঙ্গে বাস্তবের মিল কদাচিৎ। দশর্ক যারা এসব সিরিয়ালের তাদের ধারণা আদালত সম্পকের্ খুবই কম। যে কারণে অকাল্পনিক ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ মানুষ এত আগ্রহ ও নেশাসক্ত হয়ে দেখছে। কেউ কেউ নিজের উকিলকে কে ডি পাঠকের সঙ্গে তুলনা করে না পেরে আইনজীবীকে অপমানজনক কথা বলেন এমনও শোনা যায় আদালতপাড়ায়। অনেক জনপ্রিয় নাটক ‘আলাউদ্দিনের ফঁাসি’ দেখছিলাম। বিচারককে যে পোশাকে বিচারকের আসনে বসানো হয়েছে তা ভুল, সাক্ষীর জেরাকে বারবার নাটকে আরগুমেন্ট বা যুক্তিতকর্ হিসেবে বলা হচ্ছিল। আরও অনেক অসামঞ্জস্য চোখে পড়ার মতো। আইনজীবী হিসেবে নাটকটি দেখতে বসেছি বলে বৈসাদৃশ্য লেগেছে। কিন্তু যারা আইনজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাদের কাছে যাচ্ছে ভুল বাতার্। কলকাতার চলচ্চিত্র ‘মুক্তধারা’য় আসামির অপরাধ বণর্না করা হচ্ছে যে, তার সবচেয়ে বড় অপরাধ সে অপহরণকারী। এ ছাড়া সে খুনসহ আরও অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বাস্তবে খুনের চেয়ে অপহরণ বড় অপরাধ কীভাবে হয়? অপহরণের মাধ্যমে খুন করলেও বিচারে খুনের সাজাই হবে। আরেক চলচ্চিত্রে দেখাচ্ছে, নায়ক চলচ্চিত্রে উকিলের পোশাক পরে শ্যুটিং করে মনের দুঃখে বাবার চেম্বারে বসে আছে। কোনো একটি মামলায় সে ন্যায়-বিচার এনে দিল অভিনয় দক্ষতায়। পরে সে নিয়মিত উকিল হয়ে অভিনয় করে যাচ্ছে দিনের পর দিন! বাস্তবে যে কেউ চাইলেই আইনজীবীর পোশাক পরে আদালতে শুনানি করতে পারবেন না। তার ওপর যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার কিছুই আদালতের বা আইনের ভাষা নয়। জনপ্রিয় ছায়াছবি ‘আয়নাবাজি’ ছবিতে দেখতে পাই, আসামিকে জামিন দেয়ায় সে কাঠগড়াতেই নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। এমন বাস্তবে করলে আদালত অবমাননা হয়ে যাবে। আমরা সিনেমা বলে মেনে নিচ্ছি সহজেই। বাংলা ছবিতে দেখা যায় আদালতে বিচার চলা অবস্থায় হঠাৎ করে রক্তাক্ত কেউ হাজির হয়ে যায় এবং আদালত তার সাক্ষী গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে বিচার কাজ শেষ করে ফেলে। কিন্তু বাস্তবে এটি সম্ভব নয়। সিনেমার প্রয়োজনে আমরা এসব বুঝে নিচ্ছি। নারী নিযার্তন আইনে ধষের্ণর মামলায় ১৪ বছরের জেলের কোনো বিধান নেই কিন্তু এটি অনেক বাংলা সিনেমায় মুখে মুখে বলে কুশীলবরা। সিনেমায় দেখা যায়, সাক্ষী জেরা, প্রমাণ উপস্থাপনসহ আরগুমেন্ট সব বিষয় একই স্টেপে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি আলাদা আলাদা স্টেপ। ক্লাইমেক্সের জন্য প্রতিটি কথায় আরগুমেন্ট বা যুক্তিতকর্ আকারে উপস্থাপন করা হয়। মিডিয়ায় এই ব্যবস্থাগুলো উপস্থাপন করার আগে তা সম্পকের্ ভালো করে জেনে নেয়া, বুঝে প্রকাশ করা উচিত। হ্যঁা, কিছু বিষয় অবাস্তব, অকাল্পনিক উপস্থাপন অবশ্যই করা যাবে প্রয়োজনে, তবে আদালতের বিচারব্যবস্থা, আইনজীবীর কাজের পদ্ধতি, আইনের সঠিক ব্যাখা প্রদান করা উচিত। মানুষকে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভুল উপস্থাপন বা ব্যাখা করলে অবশ্যই ভুল বাতার্ যাবে সমাজে। প্রয়োজনে টিভি সিনেমায় আদালত ব্যবস্থা উপস্থাপনের একটি গাইডলাইন করে দেয়া যেতে পারে। অশোভন, অকাল্পনিক, আকাশ কুসুম ও অসাঞ্জস্যতার মাধ্যমে আইনের ভুল ব্যাখা কাম্য নয় কোনোভাবেই। নাটক-সিনেমায় পুলিশের ভ‚মিকা যেন নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা না হয়, যাতে পুলিশের প্রতি জনগণের বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় তার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অনুমতি নেয়ার বিধান করা হয়েছে। তেমনই সেন্সর বোডের্র আরও সচেতন থাকা সময়ের দাবি। প্রয়োজনে আইন, আদালত ও আইন পেশার মযার্দা রক্ষায় সুনিদির্ষ্ট নীতিমালা করা যেতে পারে। লেখক : আইনজীবী, জেলা জজ কোটর্, ময়মনসিংহ