নদীগভের্ জমি বিলীন হলে করণীয়

বষার্ ৗেসুমে বাংলাদেশের নানা স্থানে নদীভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের ফলে বহু মানুষ তাদের জমিজমা হারায় নদীগভের্। এবারও উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের নানা জায়গায় মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন। নদীগভের্ জমি বিলীন হওয়ার পর সেই জমির ওপর আইনগত স্বত্ব ধরে রাখা এবং পরবতীর্ জমি জেগে উঠলে তাতে স্বত্ব দাবি করার নিয়ম নিয়ে লিখেছেন

প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আবরার মাসুদ
এবারের বষার্য় নদীভাঙনের অনেক খবর পাওয়া গেছে। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বহু মানুষের কৃষিজমিসহ বাস্তুভিটা পযর্ন্ত। কেবল পদ্মা নদীর তীব্র ভাঙনে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় শত শত ঘরবাড়ি ও বড় বড় স্থাপনা নদীগভের্ বিলীন হয়ে গেছে। এর ফলে ওই অঞ্চলের চার হাজারেরও বেশি পরিবার সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছে। সেখানে মুহূতের্ তিন তলা একটি ভবন ভেঙে পদ্মায় বিলীন হওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শরীয়তপুর জেলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষের এই উপজেলাটিই এখন নদীভাঙনের কারণে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে বলে স্থানীয় লোকজন বলছেন। গত আড়াই মাস ধরে চলা নদীভাঙন পুরো উপজেলার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তারা অভিযোগ করেছেন, বছরের পর বছর নদীশাসন বা খনন না করায় এবার পদ্মা নদীর ভাঙন অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অনেক দেরিতে নদীশাসনের প্রকল্প অনুমোদনের পর এর কাজ শুরু করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ এখন নদীর স্রোত কমা বা ভাঙন বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কয়েকদিন আগে সবার চোখের সামনে তিন তলা নীল একটি ভবন পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এই ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নে। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। নদীগভের্ জমি বিলীন হওয়ার পর সেই জমির ওপর আইনগত স্বত্ব ধরে রাখার জন্য বিশেষ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং পরবতীর্ জমি জেগে উঠলে তাতে স্বত্ব দাবি করারও বিশেষ পদ্ধতি আছে। সিকস্তি ও পয়োস্তি : এ ক্ষেত্রে ‘সিকস্তি’ ও ‘পয়োস্তি’ এই দুটি পরিভাষার সঙ্গে পরিচিতি থাকা প্রয়োজন। ডুবে যাওয়া জমিকে ‘সিকস্তি’ ও জেগে ওঠা জমিকে ‘পয়োস্তি’ বলে। ‘সিকস্তি’ শব্দের শাব্দিক অথর্ হলো ভাঙা। যদি কোনো জমি/ ভ‚মি ভেঙে নদীগভের্ বিলীন হয়ে যায় তবে তাকে ‘সিকস্তি’ বলে। অন্যদিকে ‘পয়োস্তি’ শব্দের শাব্দিক অথর্ হলো সংযুক্ত বা একত্রীভ‚ত হওয়া যাকে আইনি ভাষায় পয়োস্তি বলে। কোনো জমি সাগর বা নদীর গতিপথের পরিবতের্নর কারণে কিংবা নদীর পানি সরে যাওয়ার ফলে জেগে উঠলে অথবা নদীগভের্ বিলীন হয়ে যাওয়া জমি আবার ভেসে উঠলে তাকে ‘পয়োস্তি’ বলা হয়। এই ‘পয়োস্তি’ বা জেগে ওঠা জমি দুই ধরনের হতে পারে : (ক) ভেঙে যাওয়া জমি আবার জেগে ওঠা এবং (খ) নতুন কোনো জমি জেগে ওঠা। সিকস্তি ও পয়োস্তিসংক্রান্ত অধিকার : নদীগভর্ থেকে জমি জেগে ওঠার পর অতিরিক্ত খাজনা প্রদান করে ওই জমি ফেরত পাবার অধিকার। জমি নদীগভের্ বিলীন হলে কর মওকুফের জন্য রাজস্ব কমর্কতার্র নিকট দরখাস্ত দাখিলের অধিকার। নদীভাঙার ফলে পরবতীের্ত জমি/ চর জেগে উঠলে তার নকশা সম্বন্ধে নোটিশের মাধ্যমে জানার অধিকার। নদীগভর্ থেকে জমি জেগে উঠলে আগের মালিকের জমি ফেরত পাওয়ার অধিকার। পয়োস্তি জমির জন্য খাজনা প্রদানের পর রশিদ পাওয়ার অধিকার। অন্য কাগজপত্র হারিয়ে গেলে খাজনার রশিদের মাধ্যমে মালিকানা দাবির অধিকার। (১৯৫০ সালের স্টেট একুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্টের ৮৬ ধারা)। নদীগভের্ বিলীন হওয়া সম্পত্তি কি ফেরত পাওয়া যায়? ১৩ জুলাই ১৯৯৪ সালের পর থেকে ভেঙে যাওয়া বা নদীগভের্ বিলীন হয়ে যাওয়া জমি ৩০ বছরের মধ্যে জেগে উঠলে আগের মালিক তথা ভেঙে যাওয়ার আগের মালিক জমি ফেরত পাবেন, তবে যে মালিকদের জমি ৬০ বিঘা বা তার বেশি পরিমাণ জমি আছে তারা ভেঙে যাওয়া জমি ফেরত পাবে না। তবে ৬০ বিঘার কম জমি থাকলে ৬০ বিঘা পূরণ করতে যতটুকু জমির প্রয়োজন ততটুকু জমি ফেরত পাবেন এবং ৬০ বিঘা জমি পূরণ করে যদি কোনো জমি অবশিষ্ট থাকে তাহলে তা ‘খাস জমি’ হিসাবে গণ্য হবে। কোনো জোতের জমি বা অংশবিশেষ নদীতে ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়া অংশের জন্য মালিককে খাজনা দিতে হবে না। রাজস্ব অফিসার জমি ভেঙে যাওয়ার ঘটনা সম্পকের্ অবহিত হওয়ার পর মালিককে একটি খাজনার রশিদ প্রদান করবেন। নিমজ্জিত জমি আবার জেগে উঠলে : নিমজ্জিত জমি আবার জেগে উঠলে এই রশিদটি পয়োস্তি বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমির মালিকানা নিণের্য়র প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। কালেক্টর সবর্প্রথম জেগে ওঠা জমির দখল নিয়ে নেবেন এবং জনগণকে জেগে ওঠা জমির ব্যাপারে জানাবেন এবং নোটিশ প্রদানের মধ্যে নকশা তৈরি করাবেন। ওই জেগে ওঠা জমির নকশা/ ম্যাপ তৈরি হওয়ার পর ৪৫ দিনের মধ্যে কালেক্টর মূল মালিক বা তার আইনগত উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করবেন। তবে ওই হস্তান্তর জমির পরিমাণ মালিক প্রতি ৬০ বিঘার বেশি হবে না। এই হস্তান্তরিত জমির জন্য কোনো জমির মালিক বা মালিকের বৈধ উত্তরাধিকারীদের কোনো সেলামি দিতে হয় না তবে গ্রহীতাকে আইনানুযায়ী ধায্য ন্যায্য খাজনা বা ভ‚মি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে হবে। যদি ওই বিলীন হয়ে যাওয়া জমি প্রাকৃতিক উপায়ে জেগে না ওঠে তাহলে জমির মালিক ওই জমির দাবি করতে পারবে না। কালেক্টর কতৃর্ক জেগে ওঠা জমি দখল নিয়ে পাবলিক নোটিশ প্রদানের ১ বছরের মধ্যে জেগে ওঠা জমি নিয়ে কোনো আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে না। জমি সিকস্তি অথবা পয়োস্তি হলে যা করণীয় : ১৯৯৪ সালের ১৩ জুলাই তারিখে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করে ৮৬ ধারায় বলা হয়েছে যে, ৮৬ (১) ধারায় কোনো ব্যক্তির জমি সিকস্তি বা নদীগভের্ বিলীন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির মালিক ভ‚মি উন্নয়ন কর মওকুফের জন্য নিধাির্রত ফরমে রাজস্ব অফিসারে নিকট আবেদন করতে হবে। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে রাজস্ব অফিসার বা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) ভ‚মি উন্নয়ন কর মওকুফের আদেশ দেবেন। এই দরখাস্তই পরে জমির সত্তে¡র প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। (২) ওই সিকস্তি বা নদীগভের্ জমি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর ৩০ বছরের মধ্যে জমি জেগে উঠলে বা পয়োস্তি হলে জমির মালিক বা মালিকের উত্তরাধিকারীরা জমি দাবি করতে পারবে। (৩) এভাবে জেগে ওঠা জমির পাওয়ার জন্য গ্রহীতাকে কোনো সেলামি বা কোনো টাকা-পয়সা দিতে হবে না তবে তাকে ভ‚মি উন্নয়ন কর দিতে হবে। বিলীন হওয়া জমি জেগে উঠলে : ১৯৫০ সালের স্টেট একুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্টের ৮৭ ধারায় নদী বা সাগর সরে যাওয়ার ফলে যদি কোনো জমি জেগে ওঠে তাহলে জমির আগের মালিক সেই জেগে ওঠা জমির মালিকানা দাবি করতে পারবে না কারণ ওই জমি সরকারের হাতে অপির্ত হবে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এই ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে সাগর বা নদী সরে যাওয়ার দরুণ কোনো জমি জেগে উঠলে বা জেগে উঠেছে এমন জমির জন্য ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টের আদেশ নং ১৩৭ বলবৎ হওয়ার আগে যদি কোনো ব্যক্তি দাবি করে কোনো আদালতে মামলা থাকে তাহলে অত্র প্রেসিডেন্টের আদেশ বলবৎ হওয়ার পর থেকে ওই দাবিকৃত মামলার কোনোরূপ কাযর্ক্রম আর চলবে না। এমনকি অত্র প্রেসিডেন্ট আদেশ বলবৎ হওয়ার পর সাগর বা নদী সরে যাওয়ার ফলে জেগে ওঠা জমি নিয়ে আর নতুন করে কোনো আদালতে মামলা করা যাবে না।