দ্বিতীয় বিয়ে

রহিমার আইনি অধিকারে এত বিড়ম্বনা কেন?

প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বস্তির টিনসেট ভাড়া বাসা যেন রহিমার (ছদ্মনাম) স্বপ্নবিলাস। বিদ্যুতের বাতি, সাপ্লাইয়ের পানি, নাগরিক জীবনের অধিকার কিছুই প্রয়োজন নাই তার। স্বামী আর তিন সন্তান নিয়ে সুখের পরিবার। প্রত্যাশার চেয়েও যেন অনেক বেশি পাওয়া হয়েছে। স্বামী রূপবান সেখ একজন রিকশাচালক। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীর রিকশা কিনে দিয়েছে। সপ্তাহে ২৫০ টাকা কিস্তি পরিশোধে রীতিরকম যুদ্ধ করতে হয়। সেকারণ বারো বছর বয়সী প্রথম মেয়ে পাশের বাড়িতে ঝি হিসেবে কাজ করে। মেঝো মেয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। সবার ছোট দুই বছরের ছেলে। বিয়ের প্রথম জীবনে যৌতুক না আনার অপরাধে শ্বশুর-শাশুড়ির যৌথ নিযার্তন সহ্য করতে হয়েছে। অনেক কষ্টে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। ছোটবেলায় নিজ চোখে নদীতে বাব-দাদার বসত বাড়ি বিলীন হতে দেখেছে। বাবার বাড়িতেও ঠঁাই নেই। শহরে এসে ভালোই কাটছিল রহিমার জীবন। হঠাৎ এক ঝটিকা ঝড় এসো যেন রহিমার জীবন-সংসার তছনছ করে দেয়। স্বামী রূপবান সেখের চলাফেরায় কিছু পরিবতর্ন দেখতে পায় রহিমা। লাল শাটর্ গায়ে রিকশা চালানো দেখে রহিমার মন খারাপ হয়ে যায়। রাতের রিকশা চালানোর কথা বলে অধিক রাতে বাড়ি ফেরে রূপবান। রাত-বিরাতে বাড়ি ফেরার কথা জানতে চাইলেই সে উত্তেজিত হয়ে যায়। স্বামীর উত্তেজনা দেখে অতীতে শ্বশুড়বাড়ি থাকা অশান্তির কথা মনে করিয়ে দেয় রহিমার। সব নীরবে সহ্য করতে থাকে। ইদানীং রূপবান সেখের অন্যত্র রাত্রিযাপনে চিন্তিত হয়ে পড়ে রহিমা। দরিদ্রতা থাকলেও সংসারে সুখের কোনো ঘাটতি ছিল না। দুবেলা পেট পুরে খাওয়ায় যেন তাদের অনেক প্রাপ্তি। রহিমা কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। তার মনে পড়ে বিয়ের দিনের প্রতিশ্রæতির কথা। রহিমার হাত ধরে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে বলেছিল ‘তুমিই আমার জীবন সাথী’। স্বামী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। ডাক্তার বঁাচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। একদিকে রহিমা অন্যদিকে মৃত্যু, সে লড়াইয়ে রহিমার জয় হয়েছে। একজন নারীর জীবনে স্বামীই যেন সব। কমর্ক্ষম স্বামী, পাশে একজন প্রেরণাময়ী নারী, সুখ-সফলতা অবশ্যম্ভাবী। সুখ-দুঃখের স্বপ্নে গাথা রহিমার দাম্পত্য জীবন। স্বামী সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রহিমাকে নিয়ে শহরের সব অলি-গলি চিনিয়ে দেয়। মাঝে-মধ্যে সিনেমা দেখে। শহরের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে গিয়ে ধনী দম্পতিদের মতো ওরাও ঝাল-মুড়ি খায়। সত্যিই রহিমা অনেক সুখী। স্বামীকে জীবন দিয়ে আগলে রাখে। এত সুখ সইবে কিনা মাঝেমধ্যে চিন্তিতও হয়ে পড়ে রহিমা। একদিন রূপবান সেখের হাওলাত করা ফুলপ্যান্ট পরা দেখে রহিমার সন্দেহ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। স্বামীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে সে। অবশেষে তার সন্দেহ সত্যি হলো। রূপবান সেখ রহিমার অনুমতি না নিয়ে পাশের বস্তির এক স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে বিয়ে করেছে। শ্বশুরবাড়িতে দরজা বন্ধ করে উচ্চশব্দে গান শুনছে। এদিকে রহিমার হৃদয়ভাঙা আত্মচিৎকারে ওই বিয়েবাড়ি যেন প্রকম্পিত। রূপবান সেখ রেগে বাঘ। তার নতুন শ্বশুরবাড়িতে রহিমার উপস্থিতি। তাও উচ্ছৈঃস্বরে চিৎকার, এটা যেনর জঘন্যতম অপরাধ। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। একজন মুসলিম পুরুষ চারটি বিবাহ করা অন্যায় নয়। এই রকম অকাট্য যুক্তি ধমীর্য় বিধানের সঙ্গে মিশ্রিত করে রূপবান এ বিয়েকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। একে একে পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো হলো, যার যার মতো করে যুক্তি আর সান্ত¡না দিল। সবাই একমত রূপবান যদি ভরণপোষণের ক্ষমতা রাখেন, সমতার দৃষ্টি রাখে, তাহলে আরও দুটি স্ত্রী নিতে বঁাধা কোথায়! রহিমা পাগলের মতো বিচারের জন্য ছুটে বেড়ায় এখানে-সেখানে। ছিন্ন-ভিন্ন দ্বি-খÐিত হৃদয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে। শত দরিদ্রতা, কষ্ট আর অভাবের মধ্যেও স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল না। একটা ছেঁড়া কাপড়, অন্যের বাসায় কাজ করে নিজে না খেয়ে স্বামীর জন্য অন্ন সংস্থান, ঋণ করে স্বামীর রিকশা কিনে দেয়া, জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নানা ভাবনায় রহিমার বুক ফেটে কান্না আসে। পৃথিবীতে ভালোবাসার কথামালা কি মিথ্যা! স্বামী-স্ত্রীর সম্পকর্ কি এতই ক্ষণস্থায়ী! প্রেম, দয়া, ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভবিষ্যৎ সবই কি বৃথা! স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গোপনের প্রতিজ্ঞা, দুজনের স্বপ্নের বুনিয়াদ সবই কি মিথ্যা! রহিমার মন এসব প্রশ্নে উত্তর খঁুজে বিষণœতায় ভারাক্রান্ত। বৃষ্টির মতো কঁাদতে ইচ্ছে করে। বৃষ্টির ভিতরে বজ্রপাতের মতো অগ্নিকুÐলি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিতে চায় রূপবানের দ্বিতীয় সংসার। রহিমার জীবন কাহিনী মন দিয়ে শুনলাম। আইনি সাহায্য পেতে আমার চেম্বারের আগমন। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ (৫)(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বা সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া একজন বিবাহিত পুরুষ প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে না। যদিও প্রচলিত আইনে দ্বিতীয় স্ত্রী এই অপরাধের আওতায় পড়বে না। রহিমার ক্ষোভ স্বামীর চেয়ে সতীনের দিকে বেশি। এ কেমন আইন! যে আমার স্বামীকে কেড়ে নিল তার শাস্তি হবে না! অপরাধের ধারাও জামিন যোগ্য! রহিমাকে আদালতে গিয়ে বিচার চাইতে হবে। দ্বিতীয় বিবাহের কাবিন দেখাতে হবে। আইনজীবী, মহুরি, পথভাড়া, পেশকার, পিয়ন, সবোর্পরি রিকশার কিস্তির টাকা সব কিছু শুনে সে নিবার্ক। আইনজীবীর খরচ বাদ দিয়ে আইনি সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিলাম। আদালতে যাওয়া-আসার পথ ভাড়াই তার নাই। মামলা করবে কীভাবে। বিচার চাইতে টাকা খরচ করতে হয়। স্বাস্থ্য সেবা পাইতে টাকা খরচ করতে হয়। শিক্ষা অজের্নর জন্য টাকা খরচ করতে হয়। সরকারি সব সেবা পাইতে টাকা খরচ করতে হয়। তাহলে রহিমার জীবনে রাষ্ট্রের আর কি প্রয়োজন থাকতে পারে। রহিমা জানতে চায় আসামি ধরার সঙ্গে সঙ্গে বিচার ও সাজা একই দিনে শেষ হবে কিনা? সবের্শষ আইনি প্রতিকার পাইতে কত দিন সময় লাগতে পারে। এই রকম আইন জামিন যোগ্য কেন? এরকম নানা প্রশ্নবানে আমাকে জজির্রত করে ফেলে রহিমা। অবশেষে রহিমার বিচারপ্রাথীর্ হওয়ার আকাক্সক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। রূপবান সেখের দেখানো সব স্বপ্ন রহিমার জীবনে মিথ্যা বালুচরে পরিণত হয়। রহিমার ঘর ভাড়া বাকি পড়ে যায়, স্বামী ও সংসার হারা হয়ে তিনটি সন্তানসহ এনজিওর কিস্তির টাকা বাকি রেখেই গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। শুধু রূপবান সেখের পাশবিকতায় চারটি জীবন অনিশ্চয়তার ধ্বংস্তূপে দঁাড়িয়ে। রাষ্ট্রের আইন আর রহিমার জীবনে কোনো গুরুত্ব নেই। যে সমাজে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এক দুলর্ভ প্রক্রিয়া, সেই দেশে রহিমার বিচারপ্রাপ্তি আর কী হবে! যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক রহিমাদের বিচার দিতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। রহিমার আইন প্রাপ্তির সুবিধা রাষ্ট্রীয়করণ করা এখন সময়ের দাবি মাত্র। এ দাবি তার সুযোগ নয় জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স