বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পতিতাবৃত্তি ও দেশে প্রচলিত আইন

আইনি দিক থেকে জবরদস্তিমূলক শ্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উলেস্নখ রয়েছে রাষ্ট্র গণিকালয়ের পতিতাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখে।
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

শ্রাবন্তী (ছদ্মনাম) একজন পতিতা, সৎ মায়ের ঘরে বেড়ে ওঠা তার। সংসারে উপার্জনের কোনো লোক নেই। তাই সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়ে নাম লেখান পতিতাদের তালিকায়। কখনো কখনো রাস্তায়, রেললাইনের পাশে কখনো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বাসায় কিংবা হোটেলে রাতযাপন করতে হয় নতুন নতুন খদ্দেরের সঙ্গে। আর এর সঙ্গে যুক্ত থাকে কয়েকজন দালালচক্র। কোনো এক ঘটনায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বাসায়। সেখানে গিয়ে শ্রাবন্তী দেখতে পান একজন পাগলের সঙ্গে সময় দিতে হবে। এটি কী করে সম্ভব? শ্রাবন্তী প্রশ্ন করলে পাগলটির বাবা বলেন তার ছেলেটি একটি মেয়েকে ভালোবাসতো সে আজ তার জীবনে নেই। যত টাকা লাগে সে দেবে কিন্তু তাকে কয়েক মাস তার সঙ্গে থাকতে হবে। কি করবে শ্রাবন্তী? পতিতাদের জীবনবৈচিত্র্য নিয়ে এ রকম হাজারো গল্প রয়েছে আমাদের সমাজে।

পাঠক নিশ্চয়ই মনে আছে, বাংলাদেশে টানবাজার-নিমতলী যৌনপলিস্ন উচ্ছেদের প্রতিবাদে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দাখিল হয়েছিল। এ পিটিশনের রায়ে বলা হয়, নারী যৌনকর্মী অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের হলে এবং যৌন ব্যবসাই তার একমাত্র আয়ের উৎস হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তিনি বৈধভাবে এ ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

আমাদের আইন ও সংবিধান যৌনকর্ম বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, বাংলাদেশে যৌনকর্ম বৈধ। কিন্তু সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, 'রাষ্ট্র জুয়া এবং যৌন ব্যবসার বিরুদ্ধে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করিবে।' আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ সুযোগটি ব্যবহার করেই যুগ যুগ ধরে যৌনপলিস্ন উচ্ছেদ, নানাভাবে যৌনকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানি করে আসছে।

২০১২ সালে আমাদের দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন তৈরি হয়। এ আইনের ১২(১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি পতিতালয় স্থাপন বা পরিচালনা করিলে অথবা তাহা স্থাপন বা পরিচালনা করিতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা বা অংশগ্রহণ করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর এবং অনূ্যন ৩ (তিন) বছর সশ্রম কারাদন্ডে এবং ইহার অনূ্যন ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।

এ আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি রাস্তায় বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে অথবা গৃহ অভ্যন্তরে বা গৃহের বাইরে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে মুখের ভাষায় বা অঙ্গভঙ্গি করে বা অশালীন ভাবভঙ্গি দেখিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তিকে আহ্বান জানালে সে অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে। এ রকম অপরাধের জন্য সে অনধিক তিন বছর কারাদন্ডে অথবা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। আমাদের দন্ডবিধির ২৯০ ধারায় গণ-উপদ্রব নামের একটি আইন আছে। সেই আইনের অধীনে অনৈতিক কাজে লিপ্তদের শাস্তি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা জরিমানা।

পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমন- দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজজব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রূপজীবা ইত্যাদি। এ পেশায় নিয়োজিতরা নিজদেহ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ নিজদেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধপন্থায় অর্থোপার্জন। জর্জ স্কট তার 'পতিতা বৃত্তির ইতিহাস' নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- 'পতিতারা হলো সেই সম্প্রদায়ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।' অক্সফোর্ড ডিকশনারি মতে বেশ্যা হলো একজন নারী যে তার দেহ ভাড়া দেয় যথেচ্ছ যৌন-সংসর্গের জন্য।

বাংলা পিডিয়া তথ্য সূত্র মতে মহাভারতে উলেস্নখ আছে, একজন বেশ্যা ভালো প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এ জীবিকা সম্পর্কে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ড. অতুল সুর তার দেবলোকের যৌনজীবন বইয়ের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন 'মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল'।

রোমান ইতিহাস মতে, পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তার 'কাদম্বরী' গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাতো। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিত।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী কর্তৃক রচিত 'অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পলিস্নর অন্তরঙ্গ কথকতা' শোভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটিতে তিনি লিখেছেন 'বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের, রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন। নিষিদ্ধ পলিস্নতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই 'বসুমতী' পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।

ডা. লুৎফর রহমান তার 'মহাজীবন' গ্রন্থে লিখেছেন 'এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন নাই থাকত তাহলে তারা অনেক আগেই হারিয়ে যেত।' প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি' বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এ সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।

দেহব্যবসা নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতাবিরোধী। এ ব্যবসাটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। পৃথিবীর সব ধর্ম শাস্ত্রে দেহব্যবসাকে বড় ধরনের পাপ বলা হয়েছে। দেহব্যবসা জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর বিধায় পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। বেশ্যাবৃত্তি সাধারণভাবে ভারতে বেআইনি নয়, কিন্তু ব্যবসার জন্য যৌনতার ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্য ইমমরাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট ১৯৫৬ রচিত হয়েছে এটি রোধ করার জন্য। এ আইনের উদ্দেশ্য হলো নারী ও শিশু পাচার বা যৌনকর্মে লিপ্ত করার জন্য তাদের সংগ্রহ বন্ধ করা, যাতে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনব্যবসার বলি না হতে হয়।

পৃথিবীর যে সব দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃত সে সব দেশে পতিতাদের নিয়মিত নির্ধারিত সময়ান্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোনো পতিতার মধ্যে যৌন সংক্রামক জীবাণু বা ব্যাধি পাওয়া গেলে তাকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হওয়া বা আরোগ্য লাভ না করা পর্যন্ত এ পেশায় আবার ফিরে আসতে দেওয়া হয় না। আমাদের সংবিধানে যেহেতু এ ব্যবসাটি নিষিদ্ধ তাই আমাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সংবিধানে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু ব্যবসাটি চালু আছে সেহেতু এ ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের মাধ্যমে যেন কোনো যৌনব্যাধি যেমন সিফিলিস, গণরিয়া প্রভৃতির বিস্তার না ঘটে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের সচেষ্ট থাকা উচিত।

আইনি দিক থেকে জবরদস্তিমূলক শ্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উলেস্নখ রয়েছে, রাষ্ট্র গণিকালয় পতিতাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখে। এ সব বসতিস্থল সাধারণত বেশ্যাপাড়া বা পতিতালয় নামে সুপরিচিত। পতিতারা তাদের পেশার জন্য হলফনামা দিয়ে অনুমতি গ্রহণ করতে পারে।

ফ্রান্সে পতিতাবৃত্তি আইনসম্মত। কিন্তু সেখানে অপ্রাপ্তবয়স্কদের দিয়ে যৌনকর্ম করানো আইনসম্মত নয়। তা ছাড়া যৌনকর্মীদের নিয়ে কেনাবেচাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জার্মানিতে পতিতাদের সঙ্গে কনডম ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো 'বাংলাদেশ থেকে পতিতাবৃত্তির অবসান হয়েছে, পতিতাদের পুনর্বাসন হয়েছে' সেদিন আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী চিরন্তন রূপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী,

আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ঊসধরষ:ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে