বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিচার বিভাগ অবমাননা এবং জাস্টিস অব দ্য পিস

বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায়, ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রণয়নের সময় ২২-২৫ ধারায় জাস্টিস অব পিসসংক্রান্ত বিধান আলোচনা করা হয়। ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯২৩-এর ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী ১৯২৩ সালে ২৩ ও ২৪ ধারা বাতিল করা হয়। ২৫ ধারায় পদাধিকারবলে জাস্টিস অব পিস হিসেবে কাজ করার বিধান রাখা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ২৫ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পদাধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা সারা বাংলাদেশের জন্য, দায়রা বিচার, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

পাঠক! নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে পুলিশ প্রধান শাহাদুল হকের চাকরিচু্যতির গল্পের কথা। সেই ২০০৩ সালের ১৯ জুন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সরকারি গাড়িযোগে বনানী কামাল আতাতুর্ক এলাকা অতিক্রম করছিলেন। সে সময় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারপতি মহোদয়ের গাড়ি থামিয়ে পুলিশের নীল রঙের একটা জিপ গাড়ি আগে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। একই সঙ্গে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে স্যালুট প্রদান করেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে বিচারপতি মহোদয় গাড়ি থেকে নেমে সার্জেন্টের কাছে জিজ্ঞেস করেন, সুপ্রিম কোর্টের লোগো সংবলিত গাড়ি ও কালো পতাকা দেখে সালাম না করার কারণ কি? সার্জেন্ট বলে যে, আমরা সুপ্রিম কোর্টের পতাকা স্যালুট করতে বাধ্য নই। আমাদের অত ঠ্যাকা পড়ে নাই! বিষয়টি নিয়ে সার্জেন্ট সোয়েবুর রহমান বিচারপতি মহোদয়ের সঙ্গে তর্কে জড়ান। পরে আশপাশে থাকা আরও কয়েকজন পুলিশ সার্জেন্টকে ডাকেন সোয়েবুর রহমান। ৫ জন পুলিশ অফিসার জুডিসিয়ারি নিয়ে নানাভাবে কটূক্তি করেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ৩০ জুন ২০০৩ ওই পাঁচ জন পুলিশ অফিসারকে সশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন।

একই সঙ্গে আইজিপি এবং পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপালকে ১২ জুলাই ২০০৩ তারিখের মধ্যে নির্দেশ দেন চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। প্রশ্নগুলো ছিল এরকম, (১) সার্জেন্ট শোয়েবের আদালতের প্রতি অবমাননার উক্তিতে পুলিশ সদস্যদের ট্রেনিং কলেজে আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কি জাতীয় ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে? (২) সকলর্ যাংকের পুলিশ কর্মকর্তা মহামান্য হাইকোর্টের লোগো সংবলিত গাড়ি বহনকারীকে স্যালুট দিতে বাধ্য কিনা? (৩) ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়ে সকল পুলিশ কর্মকর্তা সকল ইভেন্টে অনুসরণ করতে বাধ্য কিনা? ও (৪) পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণে এমনটি শেখানো হয়েছে কিনা যে, কম গুরুত্বহীন ব্যক্তির গাড়িকে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ইত্যাদি?

এই নির্দেশনা দেওয়ার কিছুদিন পরে অস্থায়ী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় তিনি আর বিচারপতি হিসেবে চাকরিতে ছিলেন না। তবে পুলিশপ্রধান চারটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ডিউটিরত অবস্থায় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারপতিকে সালাম দিতে বাধ্য ছিলেন না। যে বিচারপতি ওই আদেশ দিয়েছিলেন সে এখন আর চাকরিতে নেই। ওই বিচারপতিকেই বরং দেশের প্রচলিত আইনে সরকারি কাজে বাঁধা দেওয়ার ও পুলিশ অফিসারকে হুমকি দেওয়ার জন্য বিচার করা উচিত। একইসঙ্গে আইজি বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে কটূক্তি করেন। জবাবের কপি আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন এবং বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহম্মেদ স্বপ্রণোদিতভাবে আইজিপির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইসু্য করেন। একই সঙ্গে আইজিপিকে সশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। আইজিপি সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। হাইকোর্ট ডিভিশন আইজিপি শাহাদুল হকসহ চার জন পুলিশ অফিসারের জবাবে সন্তুষ্টি না হওয়ায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেন।

হাইকোর্ট ডিভিশনের আদেশের পরে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা অভিমত দেন, দি পাবলিক সার্ভেন্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ অনুযায়ী পুলিশপ্রধান শাহাদুল হকের চাকরিতে থাকার সুযোগ নেই। রায় প্রদানের সময় আইজিপি ফ্রান্সে ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে ছিলেন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সে যখন দেশে আসেন সে সময় তাকে বিমানবন্দরে পুলিশপ্রধান হিসেবে প্রোটোকল দেওয়া হয়নি। তাকে সাময়িক পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ডিএমপির কমিশনারকে চার্জে রাখা হয়। পরে সাসপেন্ড করা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশন এ রায়ে জুডিশিয়ারির মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবজারভেশন প্রদান করেন। পরে কলেবরে পাঠকের জ্ঞাতার্থে ওই পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করা হবে।

হাইকোর্ট ডিভিশন সুস্পষ্টভাবে বলে, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশসহ নির্বাহী বিভাগ আদালতকে সহায়তা করতে বাধ্য। তাছাড়া আদালত বলতে কেবল গম্বুজাকৃতির বিল্ডিংকেই বোঝাবে না, বরং ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারা অনুয়ায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এখতিয়ার সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশেই এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় পুলিশপ্রধানসহ বিবাদীপক্ষ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপে কোনো যুক্তি না থাকায় আপিল খারিজ করে দেয়।

বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায়, ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রণয়নের সময় ২২-২৫ ধারায় জাস্টিস অব পিসসংক্রান্ত বিধান আলোচনা করা হয়। ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯২৩-এর ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী ১৯২৩ সালে ২৩ ও ২৪ ধারা বাতিল করা হয়। ২৫ ধারায় পদাধিকারবলে জাস্টিস অব পিস হিসেবে কাজ করার বিধান রাখা হয়।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ২৫ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পদাধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা সারা বাংলাদেশের জন্য, দায়রা বিচার, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

অথচ পত্রিকার পাতায় খবর এসেছে, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম তানভীর আরাফাত অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ, আক্রমণাত্মক ও বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সরকারি দায়িত্বপালনে পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছেন।

বিচারকের সঙ্গে পুলিশের অসদাচরণের চাক্ষুস সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানোয় ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই প্রিজাইডিং অফিসারকে ও তার পরিবারের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে 'অসৌজন্যমূলক আচরণ' এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা 'লঙ্ঘনের' অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাতকে।

উলেস্নখ্য, পুলিশ সুপার ও তার সঙ্গীয় ফোর্সদের আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ২০১০-এর ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০ ও ৮১ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কেন্দ্রের আশপাশে যে কোনো প্রকার অস্ত্র বহন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, তিনি ৩০-৪০ জন সশস্ত্র পুলিশসহ নির্বাচন কেন্দ্রে প্রবেশ করেছেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ভোটার ছাড়া শুধু দায়িত্ব পালনরত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশ করার অধিকার রাখেন। পুলিশ সদস্যের সেখানে যাওয়ার কোনো প্রকার সুযোগ নেই। এটা তাদের কাজও না। সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার কি প্রয়োজনে এবং কোনো এখতিয়ার বলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে বিচারকের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন। এ বিষয়ে অতীতের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি ব্যবস্থা নেন সেই প্রতীক্ষার পথ চেয়ে...।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

আইনগ্রন্থ প্রণেতা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে