কুমারী মায়ের সন্তানের স্বীকৃতি

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বাচ্চা পৃথিবীতে আসে। এবার পালা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন সনদ। সনদে বাচ্চার মা এবং অভিভাবক হিসেবে শান্তার নামটি লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু বাদ সাধে আইন। জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করার জন্য বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক। কতৃর্পক্ষ শান্তার কাছে বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য জানতে চায়...

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন শান্তা। তার প্রেমিক সুজন চাকরি করে একটি স্নাতক পযাের্য়র কলেজে। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। বাড়ি, স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে অনেকেই জানে ওদের বিয়েটা হতে যাচ্ছে। তাই ওদের অবাধ মেলামেশায় কেউই কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। হঠাৎ সুজনের মধ্যে কিছু পরিবতর্ন দেখতে পায় শান্তা। অজুহাত দেখায় অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। অবশেষে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। দিন সাতেক আগে কলেজের এক শিক্ষিকাকে বিয়ে করেছে সুজন। কিন্তু শান্তাতো ইতোমধ্যেই অন্তঃসত্ত¡া। সত্যটা জানার পর বাড়ি থেকে প্রচÐ চাপ আসে শান্তার ওপর। কেউ বলছে আইনি পদক্ষেপ নিতে; আবার কেউ বলছে বাচ্চাটিকে গভর্পাত ঘটাতে। একদিকে নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, পারিবারিক মযার্দা, সামাজিক সম্মান, লোক লজ্জার ভয় অন্যদিকে নিদোর্ষ একটা ভ্রƒণ। নানা ভাবনার আবতের্ পাগল হয়ে ওঠে শান্তা। নিজের সঙ্গে লড়াই করে রক্তাক্ত হয় প্রতিদিন, প্রতি মুহূতের্। স্বাবলম্বী শান্তা এবার সিদ্ধান্তে পৌঁছায় কিছুতেই নিষ্পাপ ভ্রƒণটাকে নষ্ট করবে না। অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো, বাতাস, খুশি, আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আর সুজনকেও জানতে দেবে না তার পিতৃ-পরিচয়। আর এসব কিছুর জন্য পুরো জীবনে যত লড়াই করতে হয় করবে। এ সন্তান হবে একান্তভাবেই ওর একার। শান্তার পরিচয়েই সন্তান এ ধরায় পরিচিত হবে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বাচ্চা পৃথিবীতে আসে। এবার পালা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন সনদ। সনদে বাচ্চার মা এবং অভিভাবক হিসেবে শান্তার নামটি লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু বাদ সাধে আইন। জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করার জন্য বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক। কতৃর্পক্ষ শান্তার কাছে বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য জানতে চায়। উত্তরে শান্তা বলল এ বাচ্চা শুধু ওর একার, বাচ্চার কোনো বাবা নেই। শান্তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ। শান্তাকে সাফ জানিয়ে দেন এ বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু হবে না। শান্তাও বাচ্চার পিতৃ-পরিচয় দাবি করে সুজনকে তার বিড়ম্বনার কারণ বানাতে চায় না। আবেদন-নিবেদনে যখন কোনো কাজই হলো না, তখন বাধ্য হয়ে শান্তা গেলেন পারিবারিক আদালতে। ১৮৯০ সালের গাডির্য়ান অ্যান্ড ওয়াডর্স অ্যাক্টের ৭ ধারা মোতাবেক ওই বাচ্চার একমাত্র অভিভাবক ঘোষণার জন্য আবেদন জানান। ওই আইনের ধারা ১১ অনুযায়ী বাচ্চার সম্ভাব্য অভিভাবকদের নোটিশ দেয়া বাধ্যতামূলক। এবার আদালতও শান্তার বাচ্চার বাবার নাম জানতে চান। কিন্তু শান্তা নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। দ্ব্যথর্হীন ভাষায় শান্তা কোটের্ক জানিয়ে দেন বাচ্চার বাবা এই বাচ্চার জন্ম বিষয়ে কিছুই জানেন না। কাজেই তার নাম এখানে অপ্রয়োজনীয়। আদালতের রায় শান্তার বিরুদ্ধে যায়। তার আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। নাছোড়বান্দা শান্তা এ রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে দ্বারস্থ হন উচ্চ আদালতে। কিন্তু সেখানেও শান্তার আপিল খারিজ হয়ে যায়। ভারতের আদালতে শান্তার এই ঘটনার মতো একটি মামলার নিষ্পত্তি হয় ২০১৫ সালে। সেখানে এক নারী বাবার পরিচয়হীন সন্তানের অভিভাবক হওয়ার জন্য সবোর্চ্চ আদালত পযর্ন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে অবশেষে সফল হন। যুগান্তকারী এক রায়ে ভারতের সবোর্চ্চ আদালত কুমারী মায়ের আইনি স্বীকৃতি প্রদান করে এবং সাফ জানিয়ে দেয়: অভিভাবক হতে বিয়ে জরুরি নয়। শান্তার মতো মা যারা, তাদের প্রত্যেকেরই সামাজিক সম্মান ও একক মাতৃত্বের বিষয়টিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে পথ দেখায় ভারতের সুপ্রিম কোটর্ (ঝখচ (ঈরারষ) ঘড়. ২৮৩৬৭ ড়ভ ২০১৫ : অইঈ ঠং. ঞযব ঝঃধঃব ঘঈঞ ড়ভ উবষযর)। মামলায় আপিলটি গ্রহণ করার সময় সুপ্রিম কোটর্ এই মমের্ নিদের্শ জারি করে যে, এ ধরনের মামলায় পারিবারিক আদালত পিতৃ-পরিচয় জানতে চাওয়া কিংবা ১১ ধারার বিধান মতে পিতার ওপর নোটিশ জারির কোনো প্রয়োজন নেই। বাচ্চাটির সাবির্ক কল্যাণের জন্য এবং অবশ্যই বাচ্চাটির জন্ম/উপস্থিতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়, এমন একজন ব্যক্তিকে, স্রেফ তার বীযর্র্ ব্যবহৃত হয়েছে এই কারণে কোটের্ উপস্থিত হওয়ার নোটিশ পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ভারতীয় সুপ্রিম কোটের্র আদেশ অনুসারে ৬ জুলাই, ২০১৫ উপরিউক্ত আদেশটি অল ইন্ডিয়া রিপোটের্ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে কোনোভাবেই আবেদনকারীর কাছে ‘বাচ্চার বাবা কে’, বা ‘তার ঠিকানা কী’ এ জাতীয় তথ্য জানতে চাইতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবেই, সকল এই প্রকার মামলার ক্ষেত্রে ১১ ধারায় বাচ্চার বাবাকে অথার্ৎ নেচারাল ফাদারকে নোটিশ পাঠানো আর বাধ্যতামূলকও ভারতে থাকল না। এই আদেশটি নিশ্চয়ই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এক যুগান্তকারী পালাবদল। কুমারী মায়ের বাচ্চার অভিভাবকত্বের প্রশ্নে ভারতের সুপ্রিম কোটর্ রাস্তা দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সুপ্রিম কোটর্ যেহেতু গণতন্ত্রের আইনসভা নয়, তাই দেশের পুরনো আইনে নিদির্ষ্ট কোনো সংশোধন আনা, কিংবা ভারতবাসীর জন্য নতুন আইন তৈরি করে দেয়া সুপ্রিম কোটের্র এখতিয়ারে পড়ে না। দেশের নিবাির্চত সরকারকেই এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে পালাের্মন্টে বিল আনতে হবে। পাস করাতে হবে আইনের নতুন খসড়া। তৈরি করতে হবে নারীদের সমান অধিকার প্রশ্নে নতুন আইন। ভারতের সবোর্চ্চ আদালতের এই রায়কে আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় অনুসরণ করার সুযোগ আছে কিনা, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় এসেছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবার পরিচয় ছাড়াই কেবল মায়ের পরিচয়ে একজন সন্তানের বেড়ে ওঠার অধিকার আছে নিশ্চয়ই। নারীরা নিজের জীবন, বেঁচে থাকা, মাতৃত্ব, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিষয়ে পুরুষের সমান অধিকার পাক, অধিকার পাক নিজের সন্তানের ‘অভিভাবক’ হওয়ারও। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও স¤পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স