শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন মেনে চলুন

পরিবেশের বিপর্যয়ের সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়, এজন্য দরকার দেশের সমগ্র জনগণের চেতনাবোধ। নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, সব আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া নগরায়ণ হওয়া উচিত সুপরিকল্পিত
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

পৃথিবীর আবির্ভাবের প্রারম্ভিক কাল থেকে মানুষ পরিবেশকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। সঙ্গে গড়ে উঠেছে মানব সৃষ্ট পরিবেশ। পরিবেশের উপর মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে পরিবেশের পরিবর্তন হয়। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, যে পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণকর হস্তক্ষেপের কারণে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সেই পৃথিবীই মানুষের অকল্যাণকর হস্তক্ষেপের কারণে প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের জন্য দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভোগ বয়ে আনে।

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত সমস্যা মারাত্মক সমস্যা। একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই অবহেলার কারণেই প্রতিদিন আমাদের চারপাশে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত পরিমন্ডল। নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এক নিঃশব্দ বিষক্রিয়ার মধ্যে। পরিবেশের মারাত্মক অবনতি আমাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের পরিবেশগত বিপর্যয়।

শব্দদূষণ বর্তমান সময়ে অন্যতম সমস্যা হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে। হাইড্রোলিক হর্ন, উচ্চমাত্রায় মাইকের আওয়াজ ও কলকারখানার শব্দ। এরপর পানিদূষণ। দেশের ভূ-উপরিস্থ পানি শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, পৌর এলাকার অপরিশোধিত বর্জ্য পানি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, তেলবাহিত দূষণ এবং নদীবন্দর ও উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রবন্দর ও জাহাজ ভাঙা কর্মকান্ড থেকে নিঃসৃত তেলজাতীয় পদার্থ দ্বারা ক্রমাগত দূষিত হয়ে চলছে। আরও রয়েছে নিষিদ্ধ পলিথিনের অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার। পলিথিনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে পস্নাস্টিক সামগ্রিকের ব্যবহার।

অন্যদিকে নগরজীবনে ভোগান্তির আরও একটি কারণ বায়ুদূষণ। শহরগুলোতে বিভিন্ন নির্মাণ কাজ এবং অন্যান্য উৎস থেকে অবারিত ধুলা নির্গমনের ফলে পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে। ধুলাবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে ফুসফুসকেন্দ্রিক রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ঢাকা জেলাসহ সারাদেশে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইটভাটা। ছাড়পত্রহীন এসব ইটভাটা মানছে না আবাসিক এলাকা, মানছে না কৃষি জমি। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ফসলি জমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ইটভাটাগুলোতে বেআইনিভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে বায়ু।

জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে শিল্পকারখানা, যানবাহনের অসম্পূর্ণ দহন থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের প্যাটিকুলেট ম্যাটার, অ্যাশ, ধূলিকণা, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রতিনিয়তই মিশে যাচ্ছে বায়ুতে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে চলছে।

জনজীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। বিশেষ করে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও পানিদূষণ সমস্যা সমাধান অতীব জরুরি। বিশ্ব পরিবেশবাদী আন্দোলনে স্টকহোম কনফারেন্স একটি মাইলফলক হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন পরিবেশকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতির বৃহৎ পরিসরে দেখার সুযোগ করে দেয়। স্টকহোমের কনফারেন্সে ১১৩টি দেশ, ১৯টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রায় ৪০০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে।

পরবর্তীতে জাতিসংঘের পরিবেশ এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত সম্মেলন (টঘঈঊউ) ১৯৯২ সালের ১৩ জুন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে মিলিত হয়। যা ধরিত্রী সম্মেলন হিসেবে বহুল পরিচিত। এ সম্মেলনে ১৭৮টি দেশের প্রায় ১০ হাজার প্রতিনিধি এবং বেশকিছু বেসরকারি সংস্থা যোগদান করে। পরিবেশ এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত এই রিও ঘোষণায় ২৭টি নীতিমালা করা হয়। উক্ত ঘোষণায় রয়েছে, উন্নয়নের অগ্রধিকারকে এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় প্রজন্মের উন্নয়ন ও পরিবেশগত প্রয়োজন ন্যায়সঙ্গতভাবে মেটানো সম্ভব হয়। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিবেশগত আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়।

বাংলাদেশ ৯ জুন, ১৯৯২ তারিখের টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব (টঘঋঈঈঈ) এ স্বাক্ষর করেছে। ১৫ এপ্রিল ১৯৯৪ তারিখে অনুসমর্থন করেছে এবং ২১ আগস্ট ২০০১ তারিখে কিয়োটো প্রটোকলে অনুপ্রবেশ (অপপবংং) করেছে।

প্রত্যেক দেশের মতো আমাদের দেশেও পরিবেশ রক্ষার জন্য বেশকিছু আইন রয়েছে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬, জাতীয় পানিনীতি (১৯৯৯), পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (১৯৯৭), বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫), বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধিত) অধ্যাদেশ (১৯৭৪), বন আইন (১৯২৭), সামাজিক বনবিধিমালা (২০০০), পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ (১৯৭৭), ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮৯, ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন ২০০১, ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২, পানিসম্পদ পরিকল্পনা আইন (১৯৯৫ সালের ১২নং আইন), পরিবেশ আদালত আইন (সংশোধন) ২০০০, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০, ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ নীতিমালা ২০০৮, পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ ইত্যাদি আইন ও নীতি তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ৬-এর উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে 'স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবে না বা ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনোভাবে উক্ত যানবাহন চালু করা যাইবে না।' উক্ত বিধান লঙ্ঘনকারীকে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড; দ্বিতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড।

পরিবেশের বিপর্যয়ের সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়, এ জন্য দরকার দেশের সমগ্র জনগণের চেতনাবোধ। নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, সব আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, তাছাড়া নগরায়ণ হওয়া উচিত সুপরিকল্পিত।

পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য উন্নয়ন কর্মকান্ডও চালিয়ে যেতে হবে যা ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত না করে এবং পরিবেশ দূষণ না করে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের অভিঘাত নগরজীবনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

বায়ুদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তিকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দক্ষতা ও ম্যান্ডেট আর সমন্বিত প্রশাসনিক পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর স্বদেশভূমি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় নাগরিকদেরও থাকতে হবে সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে