শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি আইনগত সহায়তা সংশ্লিষ্ট আইনে নারীর অবস্থান

বাংলাদেশের সহায়-সম্বলহীন, গরিব, অনগ্রসর মানুষের জন্য বিনামূল্যে আইনি সেবাপ্রদান সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসেও এই সিদ্ধান্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবার মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালতে আইনি প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে সহায়-সম্বলহীন, গরিব, অনগ্রসর মানুষের। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের অবদান এবং সাফল্য দুর্দান্ত। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের অবদান নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন সিনিয়র সহকারী জজ ফারহানা লোকমান, যিনি কুমিলস্নার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব
নতুনধারা
  ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে উলিস্নখিত নারী-পুরুষে বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। সাধারণ অর্থে ক্ষমতায়ন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ এবং অন্যকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা ও সুযোগ অর্জন।

জাতিসংঘ নারীর ক্ষমতায়নকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করেছে-

ওঃ রং :যব ঢ়ৎড়পবংং নু যিরপয ড়িসবহ সড়নরষরুব :ড় ঁহফবৎংঃধহফ, রফবহঃরভু ধহফ ড়াবৎপড়সব মবহফবৎ ফরংপৎরসরহধঃরড়হ ংড় ধং :ড় ধপযরবাব বয়ঁধষরঃু ড়ভ বিষভধৎব ধহফ বয়ঁধষ ধপপবংং :ড় ৎবংড়ঁৎপবং.

অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়ন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা নারী কল্যাণে সমতা এবং সম্পদ আহরণে সমান সুযোগ অর্জনের লক্ষ্য সামনে নিয়ে জেন্ডার বৈষম্য অনুধাবন, চিহ্নিতকরণ ও বিলোপ সাধনের জন্য এক জোট হয়। একটু ভেঙে বললে নারীর ক্ষমতায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নারী তার নিজ অবস্থান বা সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হবে, দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অবস্থান নিশ্চিত করবে যার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে তার সম্পর্কিত সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বিরাজমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাগত বৈষম্যের প্রতিবাদে সোচ্ছার হবে।

আগেই বলেছি ক্ষমতায়ন একটি প্রক্রিয়া। হঠাৎ করে একদিনে কেউ ক্ষমতায়িত হয়ে যেতে পারে না। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র, আইন, রাষ্ট্র সর্বস্তরে দীর্ঘ ও অব্যাহত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি সম্ভব না। আইনগত ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন নারীর ক্ষমতায়নের অনেক ধাপের একটি মাত্র।

বাংলাদেশের মানুষের আইনগত ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন করতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের অধীনে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম কাজ করে যাচ্ছে। এর অধীনে যে কোনো ব্যক্তি বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ প্রাপ্তি বা আপসযোগ্য বিরোধ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) বা আপস মীমাংসা করার আবেদন করতে পারে এবং আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এবং আইনগত সহায়তা প্রদান বিধিমালা, ২০১৪-এর অধীনে আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সরকারি খরচে মামলা দায়ের, পরিচালনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।

এক্ষেত্রে মামলার প্রাসঙ্গিক ব্যয় যেমন ডিএনএ টেস্টের খরচ, পেপার বিজ্ঞপ্তির খরচ, বিনামূল্যে নকলের ব্যবস্থা ইত্যাদি খরচ সরকার বহন করে। এই লেখায় জাতীয় আইনগত সহায়তা কার্যক্রম নারীর ক্ষমতায়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছে সেই বিষয়ে আলোচনা করব। নারীর কল্যাণে নারীর অবস্থান এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যকে চিহ্নিত ও অনুধাবন করে মামলা পরিচালনার জন্য আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকায় আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত আয়সীমার বাইরের এসিডদগ্ধ, শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার নারী, অসচ্ছল বিধবা, পাচারের শিকার নারী, স্বামী পরিত্যক্তা নারী ইত্যাদি নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অর্থাৎ আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ ও আইনগত সহায়তা প্রদান বিধিমালা, ২০১৪ অনুযায়ী আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও নানাবিধ আর্থ-সামজিক কারণে বিচারব্যবস্থায় প্রবেশে অসমর্থ নারীদের বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা সহায়হীন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

এই কার্যক্রমের অধীনে নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে, নিত্যদিনের কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলতে পারে এমন আইনগুলো ও সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আইনি তথ্য প্রদান, আইনি শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম, উঠান বৈঠক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, লোকগান ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যা নারীকে তার নিজের অধিকার, তার বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্য ও নির্যাতন নিরসনে সক্ষমতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করতে সহায়তা করে।

তৃণমূল পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ও মহিলাদের স্বার্থ রক্ষার্তে উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটিতে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন মহিলা শিক্ষক এবং ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটিতে ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের তিনজন মহিলা সদস্য, ইউনিয়ন কমিটির চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন মহিলা শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নীতি-নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নারীদের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যক্তি বিশেষ করে নারীদের জন্য এই সেবা সহজীকরণ করা হয়েছে। জেলা লিগ্যল এইড অফিসে নারীদের সুবিধার্তে পর্যাপ্ত বসার স্থান, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও মাতৃদুগ্ধ পান কর্নার রয়েছে। সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইনে আবেদন করারও সুযোগ রাখা হয়েছে। এই কাঠামোগত সুবিধাগুলোর কারণে একজন নারী সহজেই সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম সেবা গ্রহণ তথা নিজের আইনগত অধিকার বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে