মিথ্যা মামলা দায়ের ও মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

কামরুল হাসান (নাজমুল)
মানুষ ন্যায়-বিচারের প্রত্যাশায় আগের তুলনায় বতর্মানে প্রায় সবের্ক্ষত্রেই আদালতমুখী হয়েছে। যার ফলে দৈনিক আদালতেও বিভিন্ন বিষয়ে হচ্ছে প্রচুর মামলা। আর এসব ক্ষেত্রে আদালতে মামলা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী অপরিহাযর্। সাক্ষ্য ছাড়া বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেকেই মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। আবার অনেকে কাযির্সদ্ধির জন্য আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য উপস্থাপন করেন। এই সাবির্ক ক্ষেত্রে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক যদি বুঝতে পারেন মামলায় সাক্ষী মিথ্যা কথা বলছে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, তাহলে তিনি আইনানুসারে মিথ্যা সাক্ষীকে সাজা দিতে পারবেন। সাক্ষ্য গ্রহণের আগে প্রত্যেক সাক্ষীকে শপথ আইনের ৫ ধারা অনুসারে সত্য বলার হলফ পাঠ করতে হয়। এই হলফ করার পর হলফকারী সত্যকে সত্য হিসাবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে তুলে ধরতে বাধ্য। এ ছাড়া দÐবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষী সম্পকের্ বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সত্য বলার জন্য আইনত বাধ্যগত ব্যক্তি যদি এমন কোনো বিবৃতি আদালতে প্রদান করে যা সে মিথ্যা বলে জানে বা যা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তবে সে বা ওই ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষী দেয় বলে গণ্য হবে। কিছুদিন আগেও উটকো ঝামেলার ভয়ে মানুষ সহজে আদালতের দ্বারস্থ হতো না। তবে ইদানীং আদালত অনেকটাই মানুষের আস্থার জায়গা করে নিয়েছে। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা আছে বলেই ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কোনো ঝামেলা হলেই দেখা যায় আদালতের দ্বারস্থ হতে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধান বাংলাদেশের শ্রমগণকে এই অধিকার দিয়েছে। অন্য কোনো আইন দ্বারা এই অধিকার খবর্ করা যাবে না। আইনের সাধারণ নীতি অনুযায়ী, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন আইনের বিচারে সাজা না পায়। আদালত এবং আইন সুনিদির্ষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই কাউকে সাজা দিয়ে থাকেন। বিচারিক দৃষ্টিতে সাবির্ক প্রেক্ষিত অনুযায়ী দেওয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমা প্রমাণের পরিমাণ বা মাত্রার পরিমাপক হিসেবে দুটি মানদÐ আছে। যেমন, (ক) ফৌজদারি মানদÐ যা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের ঊধ্বের্ প্রমাণ বা সন্দেহাতীত প্রমাণ এবং (খ) দেওয়ানি মানদÐ যা সম্ভাব্য ভারসাম্যপূবর্ক প্রমাণ করা হয় প্রত্যেক মোকদ্দমার চ‚ড়ান্ত বিচারিক পযাের্য়। দেশের আদালত এবং থানাগুলোর দিকে একটু খেয়াল করে তাকালেই দেখা যায় প্রতিনিয়ত মিথ্যা মামলা হচ্ছে। আদালতে এ সব ধরনের মামলা-মোকদ্দমা প্রমাণের জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ জরুরি বটে। আমরা যারা আইন অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত তারা সহজেই বুঝতে পারি এবং প্রত্যহই দেখি, অনেকে মিথ্যা মামলা দায়েরের পর তা প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা সাক্ষীর ব্যবস্থা করে। এ সংক্রান্ত কাজে যদি আদালতে প্রমাণিত হয় সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, তবে আইন তাকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি মিথ্যা মামলা দায়ের এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তবে তার জন্য আইনে রয়েছে প্রেক্ষিত অনুযায়ী শাস্তির বিধান। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী-২০০৩)-এর সঙ্গে সবাই কম-বেশি পরিচিত। এই আইনে মামলার হারটাও অনেক বেশি। এই আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন তবে ওই ব্যক্তির সাত বছর সশ্রম কারাদÐে দÐিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অথর্দÐে দÐিত হতে পারেন। তবু এই আইনে অনেক মিথ্যা মামলা দায়ের এবং মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য উপস্থাপিত হচ্ছে। ফৌজদারি কাযির্বধি ২৫০ ধারায় মিথ্যা মামলার শাস্তির বিধান রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেয়ার সময় প্রমাণ পান যে, মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দশাের্নার নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। বাংলাদেশ দÐবিধির ২০৯ ধারা মতে, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সবোর্চ্চ দুই বছর কারাদÐসহ অথর্দÐে দÐিত হবে। আবার ২১১ ধারায় বলা হয়েছে, মিথ্যাভাবে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তি সম্পকের্ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করেন তবে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পযর্ন্ত কারাদÐ বা অথর্দÐে বা উভয়বিধ দÐে দÐিত করা যেতে পারে। মিথ্যা সাক্ষী বা সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তি সম্পকের্ দÐবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারা পযর্ন্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দÐবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের সংজ্ঞা সম্পকের্ বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি সত্য কথনের জন্য হলফ বা আইনের প্রকাশ্য বিধান বলে আইনত বাধ্য হয়ে বা কোনো বিষয়ে কোনো ঘোষণা করার জন্য আইনবলে বাধ্য হয়ে এরূপ কোনো বিবৃতি প্রদান করে, যা মিথ্যা এবং যা সে মিথ্যা বলে জানে বা বিশ্বাস করে বা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তা হলে ওই ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বলে পরিগণিত হবে। কোনো বিবৃতি মৌখিক বা অন্য কোনোভাবে দেয়া হোক না কেন তা এই ধারায় অন্তভুর্ক্ত হবে। দÐবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পকের্ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিচারবিভাগীয় মোকদ্দমায় কোনো পযাের্য় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বা মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি করে তাহলে সেই ব্যক্তির যে কোনো বণর্নার কারাদÐ হতে পারে, যার মেয়াদ সাত বছর তদুপরি অথর্দÐে দÐিত হবে। কেউ যদি আবার অন্য কোনো মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদÐ এবং অথর্দÐ হতে পারে। সবোর্চ্চ শাস্তি হিসেবে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের জন্য মৃত্যুদÐের শাস্তির বিধানও রয়েছে। দÐবিধির ১৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কাউকে মৃত্যুদÐে দÐিত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা সাক্ষ্য দান বা মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদÐে অথবা ১০ বছর পযর্ন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদÐে দÐিত হবে এবং তাকে অথর্দÐেও দÐিত করা হবে। আবার যদি ওই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে কোনো নিদোর্ষ ব্যক্তির মৃত্যুদÐ কাযর্কর হয়, তবে যে ব্যক্তি অনুরূপ মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করবে তাকেও মৃত্যুদÐে দÐিত করা যাবে। আসলে মিথ্যা মামলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য বতর্মান প্রেক্ষাপটে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যার ফলাফল অনেক ভয়াবহ। কিছু অসুস্থ মনের মানুষ দিন দিন তার স্বাথর্ উদ্ধারে নীতি-নৈতিকতার বিসজর্ন দিচ্ছে এবং মনুষ্যত্বে কালিমা লেপন করছেÑ যা দেশ ও জাতিকে কলঙ্কিত করছে। তাই মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীদের আইনের আওতায় এনে সঠিক শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা গেলে এই প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পাবে। লেখক : এলএলবি (সম্মান), এলএলএম, এমএসএস (ভিআরজে-ঢাবি) ও আইনি গবেষক; যহধুসঁষ.ষধ@িমসধরষ.পড়স