চাজির্শটের আগে হাজিরা ও আসামির ভোগান্তি

ফৌজদারি মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকেই আসামিদের নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আসামিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্যই বারবার হাজিরার বিষয়টি রাখা হয়েছে। তবে চাজির্শটের আগে আসামিদের লম্বা সময় হাজিরার শতর্ ছাড়াই জামিন দেয়া যেতে পারে কিনা, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন আবরার মাসুদ

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
দৃশ্যপট-১ সানোয়ার হোসেন একটি ফৌজদারি মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এলাকার কিছু উগ্র ব্যক্তিদের সঙ্গে মাসুদ নামের এক ব্যক্তিকে গুরুতর জখম করেছেন। এই মামলায় মোট আসামি পঁাচজন। সানোয়ার তাদের একজন। তার বিরুদ্ধে থানায় এজাহার দাখিল হওয়ার পর তিনি আদালতে আত্মসমপর্ণ করে জামিন আবেদন করেন এবং বিজ্ঞ আদালত তার আবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে জামিন মঞ্জুর করে। কিন্তু জামিন হওয়ার পরও সানোয়ারকে প্রতি মাসে একটি নিদির্ষ্ট তারিখে আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতে হয়। সানোয়ারের মামলার তদন্ত চলমান। কিন্তু তদন্তকারী কমর্কতার্ প্রতি মাসেই বিভিন্ন বাহানায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এভাবে দীঘর্ ছয় মাস ধরে সানোয়ার আদালতে হাজিরা দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু পুলিশি প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ায় তার মামলা বিচারিক কাযর্ক্রমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে না। দৃশ্যপট-২ বুলবুল আহমেদ একজন ব্যবসায়ী নেতা। তার বিরুদ্ধে চঁাদাবাজির অভিযোগে আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করেছেন একজন দোকান মালিক। এই মামলায় বুলবুল আহমেদের সঙ্গে আরও তিনজন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর বুলবুল আহমেদের নামে সমন জারি হয় এবং তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন। আদালত তার স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করে। এই মামলায় তদন্তকারী পুলিশ কমর্কতার্ মোটামুটি দ্রæততার সঙ্গেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সে হিসেবে মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুতও হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় অন্য জায়গায়। বুলবুল আহমেদের সহ-আসামিরা এই মামলায় আদালতে হাজির হয়ে জামিন না নিয়ে পলাতক থাকে। সে কারণে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারিক কাযর্ক্রম শুরু করা সম্ভব হয় না। আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার জন্য ফৌজদারি কাযির্বধিতে বেশ দীঘর্ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। আসামির সম্পত্তি ক্রোক এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তাকে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ প্রদানসহ বেশকিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এতে যে দীঘর্ সময় ব্যয় হয়, সেই সময় বুলবুল আহমেদের নিস্তার নেই। তাকে প্রতি মাসেই আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতেই হয়। ফৌজদারি মামলা দুইভাবে দায়ের হতে পারেÑ থানায় এজাহার দায়ের করে কিংবা সরাসরি আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করে। এই দুই ক্ষেত্রেই আসামির কতর্ব্য হলো আদালতে হাজির হয়ে জামিন গ্রহণ করা। আদালত আসামিকে জামিন প্রদান করলেও আসামিকে নিয়মিত বিরতিতে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। একটি মামলার বিচারিক কাযর্ক্রম শুরু হওয়ার আগে তদন্ত ও অনুসন্ধানসহ নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে দীঘর্ সময় লেগে যেতে পারে। বিচারিক কাযর্ক্রম শুরু হতে যত বিলম্বই হোক না কেন, আসামিকে কিন্তু নিয়মিতই আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতে হয়। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আসামিদের জন্য এ এক বিরাট ভোগান্তির ব্যাপার। সম্প্রতি এই নিয়ম উঠিয়ে দেয়ার সুপারিশ করেছে আইন মন্ত্রণালয়সম্পকির্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ফৌজদারি মামলায় চাজির্শট দেয়ার আগ পযর্ন্ত আসামিদের বারবার আদালতে হাজিরা দেয়ার নিয়ম তুলে দিতে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে এই কমিটি। তারা বলেছে, অভিযুক্ত হওয়ার আগেই হাজিরার নামে হয়রানি ন্যায়-বিচারের পরিপন্থী। কমিটির এই সুপারিশকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ফৌজদারি মামলায় বারবার হাজিরা দিতে গিয়ে মানুষ সবর্স্বান্ত হচ্ছে। মামলার পর অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত শেষ করে চাজির্শট দাখিলে দীঘর্সময় লেগে যায়। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই আসামিকে এই সময়ের মধ্যে দফায় দফায় হাজিরার নামে হয়রানির শিকার হতে হয়, যা ন্যায়-বিচারের পরিপন্থী। বিচারপ্রাথীের্দর ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করতে এই বিধান সংশোধন হওয়া জরুরি। তদন্তাধীন ফৌজদারি মামলায় আসামিরা আদালতে আত্মসমপর্ণ করে জামিন নিলে মামলার চাজির্শট না হওয়া পযর্ন্ত তাদের তারিখে আদালতে হাজিরা দিতে হবে নাÑ এই মমের্ আইন করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। কারণ চাজির্শট না হওয়া পযর্ন্ত কেউ আইনের দৃষ্টিতে আসামি নন। অনেক সময় দেখা যায় একটা মামলায় ৬০-৭০ জনকে আসামি করে এজাহার দায়ের হয়। কিন্তু অনেক দিন পর চাজির্শট দেয়া হয়। দীঘির্দন আসামিরা নিদির্ষ্ট সময় পরপর আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন। চাজির্শট দাখিলের আগে বিচারিক কাযর্ক্রম শুরু হয় না। এর আগে আসামির আদালতে যাওয়া ও না-যাওয়ার মধ্যে কিছু যায় আসে না। এক মাস পর পর আসামিদের আদালতে যাওয়ার কারণে উকিল, পেশকার থেকে শুরু করে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। ফলে ওই আসামির পরিবার এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যায়। এটিকে আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করেন অনেকেই। মানবাধিকারকমীর্রা মনে করেন, আদালতে আত্মসমপর্ণ করে একবার জামিন নেয়ার পরে চাজির্শট দেয়ার আগ পযর্ন্ত জামিন বহাল রাখা উচিত। তাহলে আসামিদের ওই এক মাস পর পর হাজিরা দিতে হবে না। এই লক্ষ্যে একটা আইন করার জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোটের্র সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। সুবিধা-অসুবিধা চাজির্শট দেয়ার আগ পযর্ন্ত হাজিরার নিয়ম উঠিয়ে দেয়া হলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে আসামিদের। তারা অহেতুক ভোগান্তি থেকে রেহাই হবে। প্রতি মাসে মাসে আদালতের বারান্দায় অমানবিক হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে আসামিরা। তবে কোনো কোনো আইনজীবী মনে করেন, হাজিরার বিধান উঠিয়ে দেয়া হলে আসামি পলাতক হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আইনজীবীদের আয়ও হ্রাস পাবে বলে তাদের আশঙ্কা। কারণ প্রতি হাজিরায় আইনজীবীরা আসামির কাছ থেকে একটা নিদির্ষ্ট ফি নিয়ে থাকেন। হাজিরার বিধান উঠিয়ে দেয়া হলে তারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। সব বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় সংসদীয় কমিটির সুপারিশ যৌক্তিক। সুপারিশটি সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে এবং প্রয়োজনে এজন্য ফৌজদারি কাযির্বধি সংশোধন করবে বলে সবার প্রত্যাশা। এদিকে, সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলায় চাজির্শট দাখিলের আগ পযর্ন্ত আসামি জামিনে থাকবেনÑ এমন আইন করতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়েছে।