মামলার দীর্ঘসূত্রতা রোধে যেসব বিষয় জানা জরুরি

বাংলাদেশের বিচারপ্রার্থীদের কাছে মামলা-মোকদ্দমা যেন ভোগান্তি আর দুর্ভোগের অপর নাম। একান্ত বাধ্য না হলে শান্তিপ্রিয় কোনো মানুষ এখানে মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে চান না। আদালত প্রসঙ্গে একটা কথা জনসাধারণের খুব প্রচলিত- কোর্টের ইটও টাকা চায়। বাস্তবতা আরও নির্মম। টাকা-পয়সা খরচ করে সর্বস্বান্ত হয়েও অনেক ক্ষেত্রে ফলাফল পান না বিচারপ্রার্থীরা। বিচারপ্রার্থী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালতকে জনবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করতে পারার ব্যর্থতার পেছনে রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষেরই কমবেশি দায় আছে। আদালতে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হন যতগুলো কারণে তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো- বিচারপ্রার্থীদের অজ্ঞতা ও অসতর্কতা। বিচারপ্রার্থীদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে অসাধু মহল পদে পদে তাদের বস্ন্যাকমেইল করে থাকে। আদালতের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা কোন কোন সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন, আমরা কয়েকটি পর্বে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব। আজ শেষ পর্বে থাকছে মামলার দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কিত পরামর্শ।

প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২১, ০০:০০

আইন ও বিচার ডেস্ক
১. ধার্য তারিখে এজলাসে উপস্থিত থেকে আপনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করুন প্রতি ধার্য তারিখে আদালতে এসে কেবল আইনজীবীর চেম্বারে বসে থাকবেন না। আপনার মামলার নম্বর জেনে রাখুন এবং যে আদালতে আপনার মামলা, সেখানে চলে যান। দেখুন, আপনার মামলায় সত্যি আজ ধার্য তারিখ ছিল কিনা। ধার্য তারিখ হয়ে থাকলে লক্ষ্য করুন, আপনার মামলা ডাকা হলো কিনা। মামলায় যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আপনার আইনজীবী সেই পদক্ষেপ নিলেন নাকি অহেতুক টাইম পিটিশন দিলেন সেটি মনিটর করুন। মামলায় কী শুনানি হলো, কতটা অগ্রগতি হলো সে সম্পর্কেও সজাগ থাকুন। প্রয়োজনে আদালতে আসা নবীন আইনজীবীদের কাছে বা বিশ্বাসযোগ্য কোর্ট স্টাফের কাছ থেকে মামলার অগ্রগতি বোঝার চেষ্টা করুন। ধার্য তারিখ হওয়া সত্ত্বেও আপনার মামলাটি ডাকা না হলে কোর্ট স্টাফের কাছে তার কারণ জানতে চান। সদুত্তর না পেলে বিচারককে জানান। ২. খরচার টাকা আপনার প্রাপ্য আইনজীবীর নয় দেওয়ানি মামলায় আপনার প্রতিপক্ষ টাইম পিটিশন দিলে অনেক সময় আদালত সেই পিটিশন খরচাসহ মঞ্জুর করেন। এই খরচা আপনার প্রাপ্য। ছানি মামলা মঞ্জুরের ক্ষেত্রেও আদালত আপনার অনুকূলে খরচা প্রদানের আদেশ দিতে পারেন। এরকম ক্ষেত্রে আপনার আইনজীবীর সহযোগিতায় অন্যপক্ষের কাছ থেকে খরচার অর্থ বুঝে নিন। ৩. আদালতে টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা কোনো মামলায় (যেমন পারিবারিক মামলা) আপনার তরফে আদালতে টাকা জমা দেওয়ার কথা থাকলে আইনজীবীর সঙ্গে আপনিও আদালতের সেরেস্তায় আসুন। আপনার দেওয়া পুরো টাকা আদালতে জমা হলো কিনা, নিশ্চিত করুন। এ ক্ষেত্রে আপনার আইনজীবী বা তার মোহরারকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না। ৪. সাক্ষ্য প্রদানের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিন মামলায় আপনার সাক্ষ্য প্রদানের কথা থাকলে ধার্য তারিখের আগেই আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ডকে দাঁড়িয়ে কী বলবেন, আইনজীবীর চেম্বারে গিয়ে আগেই তার প্রস্তুতি নিন। কোন কোন ডকুমেন্ট উপস্থাপন করতে হবে, তা আছে কিনা ভালোভাবে চেক করে নিন। ৫. অন্যপক্ষকে জেরার জন্য আইনজীবীকে সহযোগিতা করুন মামলায় আপনার প্রতিপক্ষ কর্তৃক সাক্ষ্যপ্রদানের দিনেই আপনার আইনজীবী যেন তাদের জেরা করেন এবং সময়ের আবেদন না দেন, সে জন্য আগে থেকে তাকে প্রস্তুত রাখুন এবং সেদিন যেন আপনার আইনজীবী সময়ের দরখাস্ত না-দেন, সে ব্যাপারে সজাগ থাকুন। জেরা করার জন্য আপনার আইনজীবীর কোন কোন তথ্য প্রয়োজন, সেগুলো তাকে আগেই সরবরাহ করুন। ৬. বাদী-বিবাদীদের কেউ মারা গেলে করণীয় দেওয়ানি মামলায় বাদী-বিবাদীদের কেউ মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদের মামলায় পক্ষ করার ব্যাপারে দ্রম্নত উদ্যোগ নিন। আপনার আইনজীবী যেন সর্বাগ্র সুযোগে এই কাজটি করেন, সেটা নিশ্চিত করুন। তবে যেসব বিবাদী সমন পেয়েও মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি, তাদের উত্তরাধিকারীদের মামলায় পক্ষ করা জরুরি নয়। সুতরাং এরকম অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিবাদীর মৃতু্যতে তার উত্তরাধিকারীদের পক্ষ করে সময় নষ্ট করবেন না। কারণ পক্ষ করলে তাদের সমন দিতে হবে এবং প্রচুর সময় নষ্ট হবে। ৭. পারিবারিক বা যৌতুকের মামলায় আপস করার চেষ্টা করুন পারিবারিক মামলায় আপনি যদি বিবাদী হয়ে থাকেন, তাহলে আপসের পথ খুঁজুন। দেনমোহর আর খোরপোষের টাকা অতি দ্রম্নত দিয়ে দেবেন এই প্রতিশ্রম্নতি প্রদান করে বিচারককে অনুরোধ করুন তিনি যেন উভয়পক্ষের মধ্যে আপস করে দেন। আপস হয়ে গেলে হয়রানি থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাবেন। দ্রম্নত মামলাটি নিষ্পত্তি হবে এবং প্রতি তারিখে আদালতে এসে বসে থাকার ঝামেলা থেকে রেহাই পাবেন। অসাধু ব্যক্তির পরামর্শে আপস না করে মামলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে বা বিচারিক আদালতের রায়ে আপনার সেরকম সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও আপিল করলে কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হবেন। কারণ মামলা দীর্ঘ হলে মামলার খরচ যেমন বাড়বে, একই সঙ্গে ডিক্রিকৃত অর্থের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। যৌতুকের মামলাতেও বাদীর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে আপস করার চেষ্টা করুন। হয়রানি এড়াতে পারবেন। এরকম মামলায় আপনি বাদী হয়ে থাকলে আপসে আগ্রহী হোন। আপস হলে দ্রম্নত আপনার পাওনা বুঝে পাবেন। আপস না করলে মামলার ফলাফল পেতে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাবে, ততদিনে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিবাদীর বিরুদ্ধে অন্য মামলা করে থাকলে সেগুলো তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিন। এতে সহজে আপস হবে। ৮. দ্রম্নত ফলাফলের জন্য অস্থির হবেন না মামলার ফলাফলের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। তাড়াহুড়ো করে আদতে তেমন কোনো লাভ হবে না। দ্রম্নত ফলাফল এনে দেওয়ার নাম করে কোনো কোনো আইনজীবী ও কোর্ট স্টাফ আপনাকে বস্ন্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেবে। এতে আপনার অর্থই নষ্ট হবে কেবল। মনে রাখবেন, বাংলাদেশের আদালতগুলোতে প্রচুর মামলা। তাই আপনাকে মামলার ফল পেতে ধৈর্যশীল হতেই হবে। ৯. ছানি মামলাকে 'না' বলুন কোনো দেওয়ানি মামলায় বাদী গরহাজির থাকায় মামলাটি খারিজ হলে কিংবা বিবাদী গরহাজির থাকায় মামলাটি একতরফা হলে আদালতের সেই খারিজ আদেশ বা একতরফা আদেশ রদরহিত করতে যে মামলা করতে হয় তার নাম ছানি মামলা। একে 'বাজে মামলা'-ও বলা হয়। অভিযোগ আছে, কিছু অসাধু আইনজীবী ইচ্ছে করেই ছানি মামলার পরিস্থিতি তৈরি করে মামলাকে প্রলম্বিত করেন। এ জন্য মক্কেল হিসেবে আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। প্রতি ধার্য তারিখে মামলায় আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা, আইনজীবীর তরফে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কিনা, সেগুলো দেখভাল করতে হবে। আপনাকে বিবাদী করে কোনো দেওয়ানি মামলা হলে আর সেই মামলায় আপনার স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সমন পাওয়ার পর অবশ্যই আদালতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। আপনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলে আপনার বিরুদ্ধে একতরফা ডিক্রি হবে এবং তখন সেই ডিক্রি বাতিল করে মূল মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আপনাকে ছানি মামলা করতে হবে। আগে যেখানে এক মামলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই প্রতিকার পেতে পারতেন, এখন সেখানে দুটি মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। মামলায় বাদী হিসেবে আপনি একতরফা ডিক্রি পাওয়ার পর কোনো বিবাদী এসে ওই একতরফার বিরুদ্ধে ছানি মামলা ঠুকে দিলে চেষ্টা করুন আপসে ছানি মামলাটি নিষ্পত্তি করে মূল মামলায় ফেরত যেতে। আপনি বিবাদী হলে বাদীকে কিছু খরচা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়ে ছানি মামলা নিষ্পত্তি করুন এবং দ্রম্নত মূল মামলায় ফিরে যান। গুরুতর কারণ না থাকলে ছানি মামলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অর্থ হলো কেবল সময় ও অর্থের অপচয়।