আদিবাসীদের জমিজমা হস্তান্তরে বিশেষ নিয়ম

আইনে আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের বিশেষ নিয়ম দেয়া হয়েছে। ওই নিয়ম প্রতিপালন না করে কোনো জমি হস্তান্তর করা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হস্তান্তর হবে না এবং হস্তান্তরগ্রহীতার পক্ষে কোনো অধিকার তৈরি করবে না। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন আবরার মাসুদ

প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
কামরুল সাহেব একজন ব্যবসায়ী ও শৌখিন মানুষ। ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি আছে তার। এর বাইরে গাজীপুরে রয়েছে অবসর কাটানোর জন্য কটেজ। এবার তিনি চান নয়নাভিরাম পাবর্ত্যাঞ্চলে একটি বাংলো বাড়ি নিমার্ণ করবেন। সে লক্ষ্যে তিনি বান্দরবনে একটি জায়গাও পছন্দ করে ফেললেন। এবার জমি কেনার জন্য আইনগত প্রস্তুতি শুরু করলেন তিনি। খেঁাজ নিয়ে জানলেন জমিটি স্থানীয় এক আদিবাসী ব্যক্তির। যিনি চাকমা নৃ-গোষ্ঠীর একজন সদস্য। কামরুল সাহেবের আইনজীবী বিষয়টি জানার পর বললেন, এই জমি যেহেতু আদিবাসী নাগরিকের তাই এর ক্রয়প্রক্রিয়া সাধারণ নিয়মে হবে না; বরং এর জন্য আইনে বিশেষ বিধান রয়েছে। কামরুল সাহেব কিছুটা বিচলিত হলেন। এত শখ করেছেন জমিটি কেনার জন্য। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত জমিটি কি তিনি কিনতে পারবেন? ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের বিশেষ নিয়ম দেয়া হয়েছে। ওই নিয়ম প্রতিপালন না করে কোনো জমি হস্তান্তর করা হলে তা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হস্তান্তর হবে না এবং হস্তান্তরগ্রহীতার পক্ষে কোনো অধিকার তৈরি করবে না। আদিবাসী বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি হস্তান্তরে কী কী বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে, আইনে তার বিস্তারিত বণর্না রয়েছে। আদিবাসী/ উপজাতি কারা? আদিবাসী (ঞযব অনড়ৎরমরহবং) ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-এর ৯৭ ধারার ১ উপধারায় আদিবাসী বা উপজাতি (ঞযব অনড়ৎরমরহবং) বলতে যেসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে বোঝায়, সেগুলো হলো (১) সঁাওতাল, (২) বানিয়াস, (৩) ভ‚ঁইয়া, (৪) ভ‚মিজ, (৫) দালুস, (৬) গারো, (৭) গÐা, (৮) হাদী, (৯) হাজং, (১০) হো, (১১) খারওয়াত, (১২) খরিয়, (১৩) কোরা, (১৪) কোচ, (১৫) মগ, (১৬) মাল এবং সুরিয়া, (১৭) পাহাড়িয়া, (১৮) মাচজ, (১৯) মÐা, (২০) মুÐাই, (২১) ওড়াং এবং (২২) তোড়ি। আদিবাসীদের সম্পত্তি আদিবাসীদের কাছেই হস্তান্তর করতে হবে উপযুর্ক্ত ২২ শ্রেণির উপজাতীয়দের জমিজমা হস্তান্তরের জন্য ১৯৫০ সালের অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-এর ৯৭ ধারায় বলা হয়েছে। ওই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে কোনো আদিবাসী যদি তার সম্পত্তি অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে চায় তাহলে তাকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত কোনো উপজাতির কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আদিবাসী ছাড়া অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে চাইলে ৯৭ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে যদি কোনো উপজাতি বা আদিবাসী রায়ত তার সম্পত্তি বা সম্পত্তির কোনো অংশ বিক্রি, দান, উইল বা অন্য কোনোভাবে কোনো আদিবাসী বা উপজাতি ছাড়া অন্য কোনো গোত্রের বা শ্রেণির কোনো ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে চায় তাহলে ওই আদিবাসী রায়তকে তার সম্পত্তি হস্তান্তরের অনুমতির জন্য রাজস্ব অফিসারের নিকট দরখাস্ত দাখিল করতে হবে। ওই দরখাস্ত পাওয়ার পর রাজস্ব অফিসার ১৯৫০ সালের অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-এর ৯০ ধারা এবং বতর্মানে প্রচলিত ১৯৮৪ সালের ভ‚মি সংস্কার অধ্যাদেশের বিধানাবলি বিবেচনা করে যদি যথাযথ মনে হয় তাহলে রাজস্ব অফিসার ওই আবেদনকারী উপজাতি বা আদিবাসী রায়তকে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করার অনুমতি দেবেন। হস্তান্তর হতে হবে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে ৯৭ ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে আদিবাসীদের তার জমি হস্তান্তর করতে হলে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে করতে হবে। যদি কোনো কারণে জমি রেজিস্ট্রেশনের আগেই কোনো আদিবাসীকে তার জমি হস্তান্তর করতে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে দলিল মতে এবং হস্তান্তরের শতর্ অনুযায়ী রাজস্ব কমর্কতার্র কাছ থেকে লিখিত সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। আদিবাসীদের জমি বন্ধকে বিশেষ নিয়ম ৯৭ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো আদিবাসী তার জমি কেবল ‘সম্পূণর্ খাইখালাসি বন্ধক’ হিসাবে হস্তান্তর করতে পারবে। সম্পূণর্ খাইখালাসি বন্ধকে বন্ধকগ্রহীতাকে সম্পত্তির দখল প্রদান করা হয়, বন্ধকের অথর্ ও তার সুদের পরিবতের্ বন্ধকগ্রহীতা বন্ধক-সম্পত্তির ভাড়া ও লাভগ্রহণ করেন, অথর্ পরিশোধে বন্ধকদাতা কোনো ব্যক্তিগত দায় গ্রহণ করেন না এবং বন্ধকগ্রহীতা সম্পত্তি খালাসের অধিকারহরণ কিংবা বিক্রয়ের মোকদ্দমা করতে পারেন না। ৯৭ ধারার ৬ উপধারায় বলা হয়েছে যে ওই খাইখালাসি বন্ধকের মেয়াদ সবোর্চ্চ ৭ (সাত) বছর পযর্ন্ত হবে এবং তা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তবে যদি কোনো আদিবাসী কৃষি ঋণ প্রাপ্তির জন্য কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কাছ থেকে অথবা কোনো সমবায় সমিতির কাছে ঋণ গ্রহণ করতে চান তাহলে উপযুর্ক্ত শতর্ প্রযোজ্য হবে না। অথার্ৎ এ ধরনের আথির্ক প্রতিষ্ঠান বা সমবায় সমিতি থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পূণর্ খাইখালাসি বন্ধক ছাড়াও সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে উল্লিখিত অন্য ধরনের বন্ধক রাখা যাবে। বিশেষ বিধান লঙ্ঘন করে জমি হস্তান্তরের ফল যদি কোনো আদিবাসী অত্র ধারার কোনো বিধান লঙ্ঘন করে সে তার জমি হস্তান্তর করে তাহলে ওই হস্তান্তর ‘বাতিল’ বলে গণ্য হবে। ৯৭ ধারার ৮ উপধারার (এ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যদি কোনো আদিবাসী রায়ত এই ধারার কোনো বিধান লঙ্ঘন করে তার কোনো সম্পত্তি বা সম্পত্তির কোনো অংশ হস্তান্তর করেন তাহলে রাজস্ব অফিসার নিজ উদ্যোগে বা উক্ত বে-আইনি হস্তান্তরের পক্ষে তার বরাবরে পেশকৃত কোনো দরখাস্তের ভিত্তিতে লিখিত আদেশের মাধ্যমে নোটিশ প্রদান করে ওই হস্তান্তরগ্রহীতাকে উচ্ছেদ করে দেবেন। তবে অবশ্যই হস্তান্তরগ্রহীতাকে এইরূপ উচ্ছেদের জন্য কারণ দশাের্নার সুযোগ দিতে হবে। আদিবাসীর জমি ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হলে ৯৭ ধারার ৮ উপধারার (বি) অনুচ্ছেদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে রাজস্ব কমর্কতার্ কোনো আদেশ দিলে অথবা কোনো আদিবাসীর জমি ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হলে রাজস্ব কমর্কতার্ ওই আদিবাসীকে অথবা তার আইনগত উত্তরাধিকারীকে কিংবা তার কোনো আইনগত প্রতিনিধির কাছে ফেরত দেবেন। যদি কোনো আদিবাসীর কোনো আইনগত উত্তরাধিকারী কিংবা কোনো প্রতিনিধি না থাকেন সে ক্ষেত্রে আদিবাসীর ওই জমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত বলে গণ্য ঘোষণা করবেন এবং রাজস্ব কমর্কতার্ ওই জমিটি অন্য একজন আদিবাসীর কাছে বন্দোবস্ত দেবেন।