ভূমি সংস্কার ও ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক আইনি আলোচনা

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০২১, ০০:০০

মো. আব্দুলস্নাহ আল মিযান
মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই ভূমি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে নানাভাবে। কোনো কোনো সংস্কার ছিল উন্নয়নমুখী। ভূমি সংস্কারসংক্রান্ত আমাদের দেশে ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশটি বিভিন্ন দিক থেকেই তাৎপর্যের দাবি রাখে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ৯৮নং আদেশের দ্বারা জমি-জমার মালিকানা সীমা নির্ধারণ করেছিল ১০০ বিঘা। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ দ্বারা একটি পরিবার কৃষিজমির খাস দখলে রাখার পরিমাণ সীমিতকরণ করা হয়েছে অর্থাৎ সর্বোচ্চ পরিমাণ ১০০ বিঘা থেকে কমিয়ে ৬০ বিঘা করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের ৬০ বিঘার অধিক জমি থাকলে বা এর বেশি ক্রয় করলে অতিরিক্ত সম্পত্তির ৫০ বিঘার জন্য বাজার দরের ২০ শতাংশ এবং ৫০ বিঘার অতিরিক্ত জমির জন্য বাজার দরের ১০ শতাংশ ভাগ হারে ক্ষতিপূরণ দিয়ে উক্ত সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করবে। তার অর্থ হচ্ছে কোনো পরিবার ৬০ বিঘার উপরে জমি নিজের মালিকানায় রাখতে পারবে না। কিন্তু খাতা-কলমে আইন থাকলেও কার্যকারিতায় তা সুফল পাওয়া যায় না। কেননা, যার টাকা আছে সে বিভিন্ন অজুহাতে নিজের নামে জমি রাখে। উলিস্নখিত ৬০ বিঘার নির্ধারিত সীমা কে মানে। তা ছাড়া অনেক চতুর ব্যক্তি নিজের নামে জমি না রেখে নাবালক সন্তানের নামে জমি রাখেন। মূলত প্রকৃত মালিক সে। যেমন এক ব্যক্তির দুই নাবালক সন্তান আছে। তার প্রচুর টাকা আছে। সে নিজের নামে ৬০ বিঘা এবং দুই সন্তানের নামে ৬০ বিঘা করে ১২০ বিঘা জমি রাখলেন। এতে সে অনেক জমির মালিক হয়ে গেল একাই। এ অধ্যাদেশের ৫নং ধারা দ্বারা স্থাবর সম্পত্তির সকল প্রকার বেনামি লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশ আমলে আসার পর থেকে কোনো ব্যক্তিই তার নিজ উপকারার্থে অন্য কোনো ব্যক্তির নামে কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন না। ফলে যার নামে স্বত্বের দলিল তাকেই সম্পত্তির প্রকৃত মালিক বলে ধরে নেওয়া হবে এবং এর বিপরীতে কোনো প্রকার সাক্ষ্যই আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। স্বত্বের দলিল যার নামে সে প্রকৃত মালিক নয়, সে অপর ব্যক্তির বেনামদার এ প্রকার কোনো সাক্ষ্য কোনো আদালতে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য হবে না। এমনকি, রেজিস্ট্রি বা দানপত্রের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হলেও প্রমাণ করতে হবে, নিজ প্রয়োজনে অথবা হস্তান্তর গ্রহীতার প্রকৃত প্রয়োজনেই তা করা হয়েছে, উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নয়। অপরদিকে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এ 'ঝধষব' বা 'বিক্রয়' একটি বিশেষ ভূমিকার অবতারণা করেছে। অত্র আইনের ৫৪ ধারার মাধ্যমে বিক্রয়ের সংজ্ঞা বিঘোষিত হয়েছে। সম্পত্তি হস্তান্তরের যে কয়টি পদ্ধতি রয়েছে বিক্রয়ের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর তাদের মধ্যে অন্যতম। বিক্রয়ের উপাদান হিসেবে সাধারণত আমরা দেখতে পাই 'পক্ষবৃন্দ, বিষয়বস্তু, হস্তান্তর, মূল্য ও বিক্রয়ের পদ্ধতি'। সম্পত্তি বিক্রয়ের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রয় করা যায় এবং দ্বিতীয়ত, সম্পত্তির দখল অর্পণ মাধ্যমে (নু ফবষরাবৎু ড়ভ :যব ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু) সম্পত্তি বিক্রয় করা যায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিক্রিত বিষয়বস্তুর মূল্য একশত টাকার কম হয়; কারণ একশত টাকার অধিক মূল্যের স্পর্শযোগ্য স্থাবর সম্পত্তি রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে হয়। স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার কিছু অধিকার ও দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সম্পত্তি বা তার স্বত্বের কোনো প্রচ্ছন্ন ত্রম্নটি থাকলে, এবং সে সম্পর্কে বিক্রেতা অবহিত, কিন্তু ক্রেতার সাধারণ সতর্কতার দ্বারা জানতে পারা সম্ভব না হলে, তা প্রকাশ করা বিক্রেতার একটি দায়িত্ব। এরূপ ত্রম্নটি প্রকাশ না করা বিক্রেতার পক্ষে প্রতারণামূলক আচরণের শামিল হবে। ওই ত্রম্নটিগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করা ক্রেতার কোনো দায়িত্ব নয়। কিন্তু ত্রম্নটি বাহ্যত স্পষ্ট হলে এবং সে সম্পর্কে ক্রেতা প্রকৃত বা আরোপিত নোটিশ পেয়ে থাকলে, বিক্রেতাকে দোষী সাব্যস্থ করতে পারবে না। সম্পত্তির স্বত্ব সম্পর্কে বিক্রেতার দখলে বা ক্ষমতার মধ্যে যে সকল দলিল থাকে, ক্রেতা অনুরোধ করলে তিনি (বিক্রেতা) ওইগুলো পরীক্ষার জন্য ক্রেতাকে দিতে আইনত বাধ্য থাকবেন। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি সম্পর্কে অথবা তাতে বিক্রেতার স্বত্ব সম্পর্কে ক্রেতা কোনো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে, বিক্রেতা যতদূর সম্ভব ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন। ক্রেতা যথাযথ সময়ে ও স্থানে বিক্রয়মূল্য হিসাবে পাওনা অর্থ প্রদানের জন্য পেশ করলে, বিক্রেতা সম্পত্তি হস্তান্তরের একটি দলিল সম্পাদন করে দেবেন। তা তার দায়িত্ব। বিক্রয়ের চুক্তির তারিখ থেকে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দখল প্রদানের সময় পর্যন্ত, বিক্রেতা তার দখলে বা নিয়ন্ত্রণাধীনে আছে এমন সম্পত্তি ও দলিলপত্রাদি নিজ সম্পত্তি মনে করে যথাযথ যত্ন নিতে তৎপর হবেন। ক্রেতা বা বিক্রেতা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির নির্দেশ ক্রমে কোনো ব্যক্তিকে সম্পত্তি দখল প্রদানে বিক্রেতা বাধ্য থাকবে। তা তার দায়িত্ব। বিক্রয়ের তারিখ পর্যন্ত সম্পত্তির সকল প্রকার কর ও ট্যাক্স পরিশোধের দায়িত্ব বিক্রেতার। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দায় সাপেক্ষে (রহপঁসনৎধহপব) বিক্রয় করা না হলে, বিক্রয়ের সময় বিদ্যমান সমস্ত দায় পরিশোধ করার দায়িত্বও বিক্রেতার উপর বর্তায়। অন্যদিকে ক্রেতা যদি সম্পত্তিতে বিক্রেতার স্বত্ব সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য জানেন যা বিক্রেতা জানেন না বলে তিনি বিশ্বাস করেন, তবে ক্রেতা ওই তথ্য বিক্রেতার নিকট প্রকাশ করবে। বিক্রয় সম্পূর্ণ করার সময়ে ও স্থানে বিক্রেতাকে অথবা তার নির্দেশিত ব্যক্তিকে সম্পত্তির মূল্য প্রদান করতে ক্রেতা অবশ্যই দায়ী থাকবে। তবে সম্পত্তি দায়মুক্ত অবস্থায় বিক্রয় করা হলে, সে ক্ষেত্রে বিক্রয়ের তারিখে কোনো দায় বিদ্যমান থাকলে, ক্রেতা সম্পত্তির মূল্য হতে দায় পরিশোধের টাকা কাটিয়া রাখতে পারেন এবং পরে তাকে তা যথাযথ প্রাপককে প্রদান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মালিকানা ক্রেতার নিকট হস্তান্তরিত হওয়ার পর, সম্পত্তির সব ধরনের ক্ষতি, ধ্বংস বা মূল্যহ্রাস ক্রেতাকে বহন করতে হবে, যদি তা বিক্রেতার দোষে ঘটেনি বলে প্রমাণিত হয়। সম্পত্তির মালিকানা লাভ করার পর ওই সম্পত্তির সব সরকারি পাওনা, খাজনা, ট্যাক্স এবং দায়সাপেক্ষে সম্পত্তি ক্রয় করা হলে তার সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে ক্রেতা আইনত দায়ী থাকবে। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মালিকানা লাভের পর ক্রেতা ওই সম্পত্তির উন্নতি অথবা তার মূল্য বৃদ্ধির সুবিধা এবং খাজনা ও মুনাফা ভোগের অধিকারী হবে। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির যথাযথ মূল্য দিয়ে দখল না পেয়ে থাকলে ক্রেতা ওই সম্পত্তির উপর দায় সৃষ্টি করতে পারেন এবং চুক্তির নির্দিষ্ট শর্তাবলি পালন অথবা তার বাতিলের উদ্দেশ্যে ডিক্রি (ফবপৎবব) লাভের অধিকারী হন। কোনো সম্পত্তির বিক্রয় সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্রেতা ওই সম্পত্তিতে কোনো দোষ-ত্রম্নটি আবিষ্কার করলে, যে দোষ-ত্রম্নটি বিক্রেতা ক্রেতার নিকট প্রকাশ করেনি, তবে সে ক্ষেত্রে ক্রেতা বিক্রেতার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা বা চুক্তিটি বাতিলের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।