মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজন আইন সচেতনতা

বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সি বা কিশোর যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। তবে কোনো শিশু (চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয়নি এমন কোনো ব্যক্তি) যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার : ৭ বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, ১২ বছরের নিচে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। ১৪ বছরের নিচে কারখানায় কাজ নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহণ খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বেআইনি। আইনে উলেস্নখ আছে, 'বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আইন অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ১৮ (আঠারো) বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।
মো. আব্দুলস্নাহ আল মিযান
  ১৩ জুলাই ২০২১, ০০:০০

সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে সবার মধ্যে একে অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ, সচেতনতা বোধ সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। বেআইনি কাজ প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন আইন ও অধিকার সম্পর্কে নূ্যনতম ধারণা অর্জন করা। নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি।

দেশে দেশে নারী ও শিশুরা সহিংসতা, দরিদ্র্যতা, বৈষম্য ও নানা দুঃখ-কষ্টে অধিকার হারা হয়ে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এসব বৈষম্য দূরীকরণ ও শিশু অধিকার রক্ষায় ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ পেশ হয় এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ থেকে এ সনদের বাস্তবায়ন বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক হয়েছে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-১৯৭৪, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতা, জোর-জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে; এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে।

যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেসব কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে শিশুদের প্রতি বঞ্চনা, বৈষম্য, অবজ্ঞা, অবহেলা, সহিংসতা ও নানামুখী নির্যাতন, নিষ্ঠুর আচরণ দুঃখজনক। যেসব শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় বিশেষত যারা পথশিশু, এতিম ও জেলখানায় কয়েদি-হাজতি মায়ের সঙ্গে আছে সেসব শিশু এবং দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের শিশু।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর অধিকার। সংবিধানের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র শিশুদের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও নৈতিকতা বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আইনে শিশুর জন্য স্বীকৃত অধিকারকে শিশু অধিকার বোঝায়। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার জন্য শিশু আইন ১৯৭৪-এর ৩৪ ধারায় মামলা করা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, যার হেফাজতে কোনো শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে শারীরিক ক্ষতি, মানসিক বিকৃতির সম্মুখীন হয়, সে ব্যক্তি দুই বছরের কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। আমাদের শ্রম আইনেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সি বা কিশোর যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। তবে কোনো শিশু (চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয়নি এমন কোনো ব্যক্তি) যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার : ৭ বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, ১২ বছরের নিচে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। ১৪ বছরের নিচে কারখানায় কাজ নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহণ খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বেআইনি। আইনে উলেস্নখ আছে, 'বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আইন অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ১৮ (আঠারো) বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।

অন্যদিকে নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন আমাদের সংগ্রামী ও সাহসী নারীরা। এ দেশের নারীদের এগিয়ে চলা খুব একটা মসৃণ নয়। তাদের অগ্রযাত্রায় শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ইভ টিজিং ও ধর্ষণ বিশাল প্রতিবন্ধকতার ভূমিকা পালন করছে। নারী নির্যাতনের সংখ্যা দ্রম্নত হারে যেন বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিকভাবে নারীরা যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। 'ইভ টিজিং, নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের শিকার' শিরোনামে সংবাদগুলো বড়ই নির্মম।

চলমান বাসে ইভ টিজিং কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। আবার কখনো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা গ্রহণে যাওয়া ছাত্রী ধর্ষিতা হয়ে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে ফিরে আসছে। কত নিরপরাধ কিশোরী-তরুণীর জীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব।

সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, 'শরিক রাষ্ট্রগুলো নারীকে সব ধরনের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসায়ের আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে'। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়। ইভ টিজিং দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৯ ধারায় দন্ডনীয় অপরাধ।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ১০ ধারায় যৌন পীড়নের শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অনূ্যন ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে এবং তার অতিরিক্ত অর্থ দন্ডও রয়েছে। আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে অনধিক ৭ বছর অনূ্যন ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং তার অতিরিক্ত অর্থদন্ড। উক্ত আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃতু্যদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডেরও বিধান রয়েছে।

যে কোনো ঘটনার শিকার হলে ভিমটিম নিকটবর্তী থানায় এজাহার দায়ের করতে পারেন। অন্যথায় সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে মামলা করা যাবে। পারিবারিক আইন, পারিবারিক আদালত এগুলো সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে জানতে হবে। পারিবারিক আইন হচ্ছে বিয়েসংক্রান্ত, দেনমোহর, বিয়ে-বিচ্ছেদ, ভরণপোষণের সমষ্টি নিয়ে। নারী ও শিশুনির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যৌন হয়রানি, ইভ টিজিং ও নারী অবমাননার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা নিশ্চিত করতে হবে।

শিশু নিপীড়ন ও নির্যাতনের মতো অপরাধেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রচারণা দরকার। সামাজিকভাবে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবার এগিয়ে আসতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে