শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ

আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধের উন্নয়ন আবশ্যক

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

আমাদের দেশে আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তবু নারীর প্রতি অপরাধ কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের দেশের মতো বেকারত্ব, হতাশা, উপযুক্ত বিনোদনের অভাব, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, সর্বোপরি প্রত্যেক ধর্মের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো সঠিকভাবে পালন না করার জন্য এ ধরনের অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। যথার্থ উদ্দেশ্য থেকে মানবমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, 'শরিক রাষ্ট্রগুলো নারীকে সব ধরনের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসায়ের আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে'। দেশীয় আইনেও এমন অনৈতিক কাজের বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়। ইভটিজিং ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৫০৯ ধারায় দন্ডনীয় অপরাধ এবং পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী-২০০৩) এ শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ১০ ধারায় যৌনপীড়নের শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অনূ্যন ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থ দন্ডও রয়েছে। আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে অনধিক ৭ বছর অনূ্যন ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ড।

সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন আনা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেন। এ অধ্যাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০ নামে অভিহিত হয়। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃতু্যদন্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে, তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে।

ধারা ৯(১)-এ যাবজ্জীবন শাস্তির পরিবর্তে করা হচ্ছে 'যাবজ্জীবন অথবা মৃতু্যদন্ড'। আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ড রাখার পাশাপাশি আরও সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো যৌতুকের ঘটনায় মারধরের ক্ষেত্রে (ধারা ১১-এর গ) সাধারণ জখম হলে তা আপসযোগ্য হবে। এ ছাড়া এই আইনের চিলড্রেন অ্যাক্ট-১৯৭৪-এর (ধারা ২০-এর ৭) পরিবর্তে শিশু আইন ২০১৩ প্রতিস্থাপিত হবে। অধ্যাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৮নং আইনের ধারা ৭, ধারা ৯ এর উপধারা (১), (৪), ১৯-এর উপধারা (১), ধারা ২০ ও ধারা ৩২-এ সংশোধনী আনা হয়েছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। আর সবচেয়ে যে দিকটা আমাদের বর্জন করা উচিত তা হলো বিদেশি সংস্কৃতি চর্চা, যাতে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অনেক উপাদান আমাদের চোখে পড়ে। আমি বলছি না সব বর্জন করা উচিত। তবে আগে দেশপ্রেম গড়ে উঠতে উপাদানগুলো ছেলেমেয়েদের দিতে হবে অর্থাৎ দেশীয় সংস্কৃতির শিক্ষা এবং তারপরে ওইগুলোর প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে যদি শিক্ষণীয় হয়ে থাকে। বর্জন করতে হবে সিনেমার অশ্লীল কাহিনী, নাচগান, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি যেগুলোতে যুব শ্রেণি অতি সস্তায় ও সহজে আমোদ-প্রমোদের উপকরণ খুঁজে পায়। তারা অনেক সময় এসব উদ্ভট ও অবাস্তব কাহিনীকে বাস্তব জীবন বলে চালিয়ে দিতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করে।

নানা প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে যুবকরা ভোগ ও বিলাসিতার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের যত্রতত্র ব্যবহার বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে- যা ইভটিজিংয়ের জন্য অনেকাংশ দায়ী বলে ধরা হচ্ছে। আমাদের দেশে আগত বিদেশি সংস্কৃতির গতিপথ নিয়ন্ত্রিত করতে হবে সমাজের সচেতন মানুষকে এবং সরকারকে। বিদেশি সংস্কৃতির যে অংশটুকু ইতিবাচক তাহাই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। নেতিবাচক অংশটুকু বর্জন করা আবশ্যক। শাসন ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে; কেননা, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা দেশের পরিবেশ কলুষিত করে। মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা আবশ্যক। সৎ, আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষে সমাজ পরিপূর্ণ করে তুলতে পারলেই জাতির প্রকৃত উন্নতি ঘটবে এই ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। মেয়েদের প্রতি বখাটেদের উৎপাত বা ইভটিজিং বন্ধে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ইভটিজিং বন্ধে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ, ইভটিজিং ও নারী অবমাননার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরামর্শ কেন্দ্র চালু করা এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা ক্লাশের ব্যবস্থা করা দরকার। ছাত্রীদের জন্য মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার। পরিবার-সমাজ, বিদ্যালয়ের মতো জায়গাগুলোতে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার করা উচিত। পরিবার প্রধানদের খেয়াল রাখতে হবে- সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করার দায়িত্ব প্রথমে পরিবারের।

সমাজ থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ আর নৈতিক শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সভ্য ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হয় না। অধিক কর্মক্ষেত্র তৈরি করে বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সময় তার স্বভাব চরিত্র ও বংশ মর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আত্মহত্যার ঘটনা পত্রিকায় বা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার বন্ধ করা। হত্যা ঘটনাকে আত্মহত্যা মামলা হিসেবে রুজু করার প্রবণতাকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

\হমেডিকেল পরীক্ষায় মানসম্মত প্রটোকল মেনে চলতে হবে, অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে এবং সবকিছুর ডকুমেন্ট রাখতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন ও আধুনিকায়ন করে সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং বিচার দ্রম্নত সম্পন্ন করতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তির বিষয়গুলোও প্রচার করা দরকার গণমাধ্যমে যাতে কেউ এই ধরনের হীন কাজ করার সাহস না দেখায়।

সভ্য সমাজে অসভ্যদের অবাধ বিচরণ রোধে বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীর ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক সমিতি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দলমতনির্বিশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে নৈতিক মানের অবক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য।

নারী নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে না পারলে সমাজে নারী নির্যাতন বেড়ে যায়। বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থা ও সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিকতার অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতনসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন।

লেখক: আইনজীবী,

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে