শতাব্দীপ্রাচীন আইনে সাজার যুগোপযোগিতা প্রয়োজন

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
একটি আইনি কৌতুকের মধ্যে দিয়েই লেখাটা শুরু করি। ৭৬ বছরের এক বুড়োকে আদালতে বিচারকের সামনে ৫০০ বারের মতো হাজির করা হয় মদ খেয়ে মারামারি করার জন্য। প্রতিবারই বিচারক তাকে খালাস দিয়ে দেন। কিন্তু কিছু দিন পর আবারও তাকে আদালতে হাজির করা হয় এবং এই হাজিরার নম্বর ছিল ৫০১তম। আত্মপক্ষ সমথর্ন করে তিনি বলেন, ৫০০তম হাজিরা উদযাপন করছিলেন তিনি। আবারও বিচারক তাকে ৫০ পেনি ফাইন করে বিদায় করে দিলেন। বলা বাহুল্য যে, শতবষর্ আগে যে আইনটির জন্ম হয়েছিল তখনকার স্বাথির্সদ্ধির প্রেক্ষাপটে। শতবষের্র বেশি হলেও এই আইনের তেমন কোনো পরিবতর্ন হয়নি। ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে আদালতে। হাতে হ্যান্ডকাপ, কোমরে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বঁাধা। মনে হচ্ছে বড় কোনো অপরাধী। কিন্তু তা নয়। কিশোরটি মাতাল অবস্থায় পথচারীদের বিরক্তি করছিল। বিরক্তি উৎপাদনের কারণে পুলিশ তাকে দÐবিধির ৫১০ ধারা অনুযায়ী আদালতে সোপদর্ করেছে। আইনজীবী মহোদয় কিশোরটির পক্ষে দোষ স্বীকারের আবেদন জানালেন। বিচারক মাত্র ১০ টাকা জরিমানা করে কিশোরটিকে ছেড়ে দেয়ার আদেশ দিলেন। কী অদ্ভুত আইন! যে দেশের ভালো কোনো হোটেলে এক কাপ চায়ের দাম ১০ টাকা। আর রাস্তাঘাটে মাতলামির শাস্তিও ১০ টাকা। দÐবিধির ৫১০ ধারা অনুযায়ী রাস্তাঘাটে মাতলামি করলে সবোর্চ্চ ২৪ ঘণ্টা বিনাশ্রম কারাদÐ অথবা সবোর্চ্চ ১০ টাকা জরিমানা। তার মানে এ ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ পঁাচ টাকা অথবা আট টাকাও হতে পারে। ২৫ বছর বয়সী এক যুবক অপরাধজনকভাবে রহিম মিয়ার গৃহে প্রবেশ করলেন। রহিম মিয়া তাকে হাতেনাতে ধরে থানাতে সোপদর্ করলেন। পুলিশ পরদিন দÐবিধির ৪৪৭ ধারায় তাকে কোটের্ প্রেরণ করেন। মাত্র ৫০০ টাকা জরিমানা দিয়ে ওই যুবক তাৎক্ষণিক বেরিয়ে এসে রহিম মিয়াকে ভয়ভীতি প্রদশর্ন করে। দÐবিধির ৪৪৭ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশের জরিমানা হতে পারে সবোর্চ্চ ৫০০ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। সেসব খেয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ ২৭২ ধারা মতে, বিক্রয়ের জন্য মজুদকৃত খাদ্য বা পানীয় দ্রব্য ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত বা অনিষ্ট করার শাস্তি হচ্ছে এক হাজার টাকা জরিমানা। ধরুন, আপনার সঙ্গে কেউ গায়ে পড়ে বিবাদ সৃষ্টি করল, ঝগড়া করল, মারধর করল। আপনি তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করলেন। পুলিশ দÐবিধির ১৬০ ধারায় অভিযোগ আমলে নিলেন। কিন্তু ১৬০ ধারায় বলা আছে, কলহ সৃষ্টি করে শান্তি ভঙ্গ করলে, মারধর করলে সবোর্চ্চ ১০০ টাকা জরিমানা। ২৯০ ধারা মতে, জনসাধারণকে উৎপাতের জন্য জরিমানা সবোর্চ্চ ২০০ টাকা। অন্যদিকে সরকারি দাবি আদায় আইনের ২নং তফসিলের ১৪নং বিধিতে বলা হয়েছে ৪০ টাকা মূল্যে অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে প্রকাশ্য নিলামের প্রয়োজন। তখনকার ৪০ টাকা আর এখনকার ৪০ টাকার মধ্যে অনেক পাথর্ক্য। বতর্মান সময়ে ৪০ টাকা মূল্যের সম্পত্তির জন্য নিলাম ডাকা নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার। এই ৪০ টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনে একটা উটের ক্ষতিপূরণের মূল্য ধরা হয়েছে সবোর্চ্চ ২০০ টাকা, আর গাধা, ছাগল এবং ভেড়ার জন্য সবোর্চ্চ ৩০ টাকা। বতর্মানে একটি উটের মূল্য হবে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা। আর একটি ছাগলের মূল্য হবে চার হাজার থেকে ১০ হাজার পযর্ন্ত। এখন দেখার বিষয় হলো এত কম পরিমাণ অথর্ এখনো আইনে বলবৎ আছে কীভাবে। আসলে আইনগুলো প্রণীত হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের অধীনে; আজ থেকে কমপক্ষে ১০০ বছর আগে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিধানের সংশোধনী হলেও উপরোল্লিখিত আথির্ক বিষয়গুলো আগের মতোই থেকে যায়। শুধু মুদ্রার নামের পরিবতর্ন করা হয়েছে। রুপির পরিবতের্ টাকা বসানো হয়েছে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টাকার মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে যেখানে জরিমানার পরিমাণ নামমাত্র তা বৃদ্ধি করে শাস্তিমূলক পরিমাণ অথর্ অন্তভুর্ক্ত করা এবং যেখানে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বা অন্য কোনো আথির্ক পরিমাণ বতর্মান টাকার মানের চেয়ে খুবই নগণ্য তা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে দঁাড়িয়েছে। ফৌজদারি কাযির্বধির ৪৮০ ধারানুসারে কোনো আদালতের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ দÐবিধির ১৭৫, ১৭৮, ১৭৯, ১৮০ বা ২২৮ ধারায় বণির্ত কোনো অপরাধ করা হলে উক্ত আদালত মনে করলে অপরাধটি আমলে নিতে পারেন এবং অপরাধীকে কিছু টাকা জরিমানা করতে এবং অনাদায়ে কিছু দিন পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত করতে পারেন। দÐবিধির ১৭৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি আইনত বাধ্য হওয়া সত্তে¡ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সরকারি কমর্চারীর নিকট কোনো দলিল পেশ না করলে, তিনি অত্র ধারায় অভিযুক্ত হবেন। অপরাধীকে ৫০০ টাকা জরিমানা করতে এবং অনাদায়ে এক মাস পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত করতে পারেন। দÐবিধির ১৭৮ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কমর্চারী কতৃর্ক প্রয়োজনীয় শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তিনি অত্র ধারায় অভিযুক্ত হবেন। অপরাধীকে ১০০০ টাকা জরিমানা করতে এবং অনাদায়ে ৬ মাস পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত করতে পারেন। দÐবিধির ১৭৯ ধারায় বলা হয়েছে, আইনত সত্য বলতে বাধ্য হওয়া সত্তে¡ প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করলে তিনি অত্র ধারায় অভিযুক্ত হবেন। অপরাধীকে ১০০০ টাকা জরিমানা করতে এবং অনাদায়ে ৬ মাস পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত করতে পারেন। দÐবিধির ১৮০ ধারায় বলা হয়েছে, আইনত বাধ্য হওয়া সত্তে¡ সরকারি কমর্চারীর নিকট প্রদত্ত বিবৃতি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে তিনি অত্র ধারায় অভিযুক্ত হবেন। অপরাধীকে ৫০০ টাকা জরিমানা করতে এবং অনাদায়ে ৩ মাস পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত করতে পারেন। দÐবিধির ২২৮ ধারায় বলা হয়েছে, বিচারবিষয়ক কাযর্ক্রমের কোনো পযাের্য় বিচারকের আসন গ্রহণকারী কোনো সরকারি কমর্চারীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করা বা তার কাজে বাধা দেয়া হলে, তিনি অত্র ধারায় অভিযুক্ত হবেন। অপরাধীকে ১০০০ টাকা জরিমানা করতে এবং অনাদায়ে ৬ মাস পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐে দÐিত করা যেতে পারে। ৪৮৫ ধারা মতে, ফৌজদারি আদালত কতৃর্ক আদিষ্ট দলিল বা জিনিস ফৌজদারি আদালতে আনতে কোনো সাক্ষী বা ব্যক্তি অস্বীকৃতি জানালে এ ধারায় সাক্ষীর শাস্তির বিধান রয়েছে। শাস্তির মধ্যে রয়েছে সাতদিনের অনধিক যে কোনো মেয়াদের জন্য বিনাশ্রম কারাদÐ অথবা ক্ষেত্র বিশেষে সাতদিনের অনধিক যে কোনো মেয়াদের জন্য আদালতের কোনো অফিসারের হেফাজতে আটক রাখা। ৪৮৫-এ ধারায় বণির্ত মতে কোনো সাক্ষীকে ফৌজদারি আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হলে এবং ওই কোনো কারণ ছাড়া সে হাজির হতে অবহেলা করে বা অস্বীকার করে অথবা আদালত থেকে সে নিধাির্রত সময়ের আগে বেআইনিভাবে চলে যায়, সে ক্ষেত্রে আদালত বিবেচনামতো ন্যায়-বিচারের স্বাথের্ সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে তাকে কারণ দশাের্নার সুযোগ দিয়ে অনধিক ২৫০ টাকা জরিমানা করতে পারেন। উপরে বণির্ত ধারাগুলো পযাের্লাচনা করলে দেখা যায়, বতর্মানে আমাদের দেশের আথর্-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বণির্ত অপরাধের জন্য সাজার পরিমাণ খুবই কম। এ ধরনের সাজা অপরাধ সংঘটনে অপরাধীকে নিরুৎসাহিত করে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ও ন্যায়-বিচার নিশ্চিতকরণের স্বাথের্ আইন আদালতের আদেশ পালন করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অবশ্য করণীয়। এমতাবস্থায় উল্লিখিত ধারায় বণির্ত অপরাধের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সাজার পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ৪৮৫এ(২) ধারায় ওই অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে আদালতকে সংক্ষিপ্ত বিচারের পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিচার দ্রæত করার লক্ষ্যে ২৬৩ ধারায় বিধান অনুসরণ করে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘সময়ের দিগন্ত’। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স