স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বাস্তব চিত্র

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

অ্যাডভোকেট উদয় তাসমির
পুলিশ বাহাদুর কর্তৃক একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি আটক হয়ে ৩ দিন নিরুদ্দেশ থাকল অতঃপর তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও অভিযুক্তের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করলেন! তিনি ধরেই নিয়েছেন এই জবানবন্দি স্বেচ্ছায় প্রদান করা হয়েছে। আইনে যে, 'যব যধং ৎবধংড়হ :ড় নবষরবাব :যধঃ রঃ ধিং সধফব াড়ষঁহঃধৎরষু' বাক্যাংশটি আছে সেটি যাচাইয়ের প্রয়োজন আজকাল আর পড়ছে না। দেশের জনগণ তাদের ট্যাক্সের টাকা যে অটোমেটেড রোবট জুডিসিয়ারির পেছনে খরচ করেন না অন্তত একথা বিশ্বাস করার পর্যাপ্ত কারণ থাকা উচিত। দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির (ঈৎচঈ- ১৬৪ ধারা) আসল উদ্দেশ্য কী? অবশ্যই পুলিশের তদন্ত কার্যক্রমের কোনো মতে ইতি টানা কিংবা সাজা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার প্রক্রিয়া দ্রম্নত শেষ করে দেয়া নয়। ইদানীং এর চেয়েও ভয়াবহ ও জঘন্য কর্মকান্ড দেখা যাচ্ছে! পুলিশ কখনো আসল অপরাধীকে ধরতে না পেরে অথবা ক্ষমতাসীন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে টার্গেটেড ব্যক্তিকে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে ১৬৪ ধারায় জুডিসিয়াল কনফেশন আদায়ের জন্য প্রস্তুত করে নিচ্ছে। গ্রেপ্তারের পর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করা মাত্রই হুজুর বাহাদুর শুধু নিশ্চিত হচ্ছেন অভিযুক্ত ব্যক্তি জবানবন্দি দিতে প্রস্তুত কি না! এরপর কিছু ফরমালিটি সম্পন্ন করে অভিযুক্তের সাজা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশ থেকে অপরাধমূলক কর্মকান্ড স্বমূলে নির্মূল করার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ ব্যাপারটা হওয়ার কথা ছিল স্বতঃপ্রবৃত্ত, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, অবাধ। \হকোনো ব্যক্তিকে যখন ৩ দিন পুলিশ কাস্টডিতে রাখার পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়, তার শরীরে মারধর ও ক্ষতের চিহ্ন থাকে এরপর তা আর স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি থাকে কি করে! এটা বুঝতে হলে জজ-ব্যারিস্টার হওয়া লাগে না। জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার ফর্মের নির্দেশনা অনুসরণ করে যদি এ ধরনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয় তাহলেও সেটির কার্যকারিতা থাকে না। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের মতামত হলো, 'অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করতে তার স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করা অনিরাপদ যেহেতু আইনে অনুমোদিত সময় সীমার বাইরে পুলিশ হেফাজতে আটকের পরে অভিযুক্তের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই জবানবন্দি 'স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়' [১৫ বিএলটি (এডি)]। একজনকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করা যেতে পারে তাই এই স্বীকারোক্তি স্বতঃপ্রবৃত্ত হতে হয়। স্বতঃপ্রবৃত্তের অর্থ কি? উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যায় বলছেন, 'কেবল সত্য বলার উদ্দেশ্যে নিজের বিবেক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অবাধে বলা। এ ধরনের স্বীকারোক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সত্য কথা বলার উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়ে থাকে। কোনো অবাধ স্বীকারোক্তি সর্বোচ্চ আস্থার দাবিদার- কারণ, অপরাধী নিজের সর্বোচ্চ বোধ থেকে এটি বলেছে' [২৪ বিএলডি, ৪৯৭]। কোনো ব্যক্তি তার নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছে বিষয়টা অবশ্যই সরল কোনো বিষয় নয়। কাউকে দোষ স্বীকারে বাধ্য করে সাক্ষ্য নেয়া মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তথা অসাংবিধানিক। দেশের উচ্চ আদালত এ বিষয়ে একাধিক গাইড লাইন দিয়েছে- আছে কেইস রেফারেন্স। সরাসরি আইনে নেই কিন্তু অভিযুক্তকে ভীতিমুক্ত করার জন্য সম্ভাব্য সব কার্যক্রম সম্পন্ন করার ডিরেকশন উচ্চ আদালতের আছে কিন্তু এগুলো কতটুকু মানা হচ্ছে তা কে দেখছে? এখন সামনে দাবি আসতে পারে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় অভিযুক্তের আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং এই জবানবন্দি কার্যক্রমের ভিডিও রেকর্ড সংরক্ষণ করা। আইন মানুষের জন্য হওয়া উচিত আইনের জন্য মানুষ নয়। উদয় তাসমির, তরুণ আইনজীবী ও অধিকারকর্মী