বয়স্ক বাবা-মায়ের অধিকার বাস্তবায়নে পরিবারের ভূমিকা সর্বাগ্রে

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়ে কষ্টকর সময়। বিশেষ করে পুরুষের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। যা হওয়া উচিত নয়, বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। লক্ষণীয়, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। সন্তান উচ্চ শিক্ষিত, ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিন্তু বাবাকে তার ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে অপমানের গস্নানি নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রম নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নিজ পরিবারে

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
সব ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকে কিন্তু সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসার মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি অপার সৌন্দর্যময় এ পৃথিবী দেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান, তারা হলেন আমাদের বাবা-মা। তাদের মাধ্যমেই আমাদের পৃথিবীতে আসা। শৈশব-কৈশোরের অসহায়ত্বের সময় পার করে সবল-সুস্থ মানুষে রূপায়িত হওয়ার পেছনে যে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, তারাই তো আমাদের মা-বাবা। জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে সন্তানদের সুখী করতে চান মা-বাবা। শিশুর বয়স বেড়ে ওঠার পর বাবা-মায়ের দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মা তার সন্তানদের লেখাপড়ার অভ্যন্তরীণ সর্বদিকে দৃষ্টি রাখেন আর বাবা তাদের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থসংক্রান্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে তাদের যদি কিছু অসুবিধা হয়েও থাকে তা তারা সন্তানের মুখ পানে চেয়ে হাসিমুখে বরণ করে নেন। সন্তান বিপদগামী হয়ে পড়ছে কিনা, আদব-কায়দার বরখেলাপ করে কিনা এ সব দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। সন্তানের নিকট বাবা-মায়ের চাওয়া-পাওয়ার শুধু একটাই যা হলো সুসন্তান হয়ে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করা। যদি কোনো সন্তান সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সুনাম অর্জন করতে পারে তাহলে বাবা-মায়ের আনন্দের সীমা থাকে না। সব বাবা-মায়েরই চান তার সন্তান শিক্ষিত, আদর্শবান ও চরিত্রবান হয়ে সমাজে দশজনের মুখে প্রশংসিত হোক। সুতরাং এমন পরম হিতৈষীর জন্য আমাদেরও করণীয় রয়েছে। তাদের সেবাযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রম্নটি করতে নেই। বাবা-মায়ের যেন নিজেদের উপেক্ষিত বলে মনে না করতে পারেন তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। যাদের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসায় আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তারা কর্মক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বাবা-মায়ের সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য আদালতে যেতে হচ্ছে। প্রবর্তিত জীবনযাত্রার মানুষের মানসিক মূল্য এবং চিন্তা ধারার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের জীবনযাত্রার এক অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পরিবার একক পরিবার, মা-বাবা আর তাদের এক জোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায়, যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্ততিরা এক নিজস্ব মনোজগৎ সৃষ্টি করে নেয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়ে কষ্টকর সময়। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। যা হওয়া উচিত নয়, বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্চনীয়। লক্ষণীয়, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। সন্তান উচ্চ শিক্ষিত, ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিন্তু বাবাকে তার ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে অপমানের গস্নানি নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রম নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নিজ পরিবারে। সামাজিকভাবে বাঙালিরা একসময় বৃহৎ পরিবারে বসবাস করত। তখন বার্ধক্যে থাকা মানুষ নাতি-নাতনি নিয়ে সময় কাটাতো। সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে মানুষ বাবা-মায়ের, দাদা-দাদি ও বৃদ্ধ স্বজনদের থেকে দূরে থাকা বা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাকে খুব অপরাধ বলে মনে করত। কিন্তু আজকের সমাজে সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। বাবা-মায়েরসহ সমাজের বৃদ্ধ ও প্রবীণ শ্রেণির প্রতি দায়িত্ব পালন ও তাদের প্রতি গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে প্রায়ই বাবা-মায়ের প্রতি অসদারচণের সংবাদ পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রবীণ মানুষই কতগুলো মৌলিক মানবিক সমস্যার শিকার হয়; এ সবের মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান, বার্ধক্যজনিত রোগ এবং যথোপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব, একাকিত্ব ও অবহেলা, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। প্রবীণদের দেখাশোনার ব্যাপারে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে এবং প্রত্যাশা থাকে যে পরিবার ও সমাজ তাদের প্রবীণ সদস্যদের যত্ন নেবে। কিন্তু দ্রম্নত আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন, ব্যাপক দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং অন্যান্য কারণে ঐতিহ্যবাহী যৌথ পারিবারিক ও সামাজিক দেখাশোনার পদ্ধতি ভেঙে পড়েছে। শিষ্টাচারিতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছে তখন বাবা-মায়ের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সেবাশুশ্রূষা প্রাপ্তির বদলে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হতে হয়। পৃথিবীর সব ধর্ম গ্রন্থে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বাধ্যকারী নির্দেশনা আছে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন ও নবীজীর হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বহুবার বহুভাবে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। মহান আলস্নাহ বলেন 'আপনার রব নির্দেশ দিলেন, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের 'উহ' শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না, আর তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন- তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল'। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন 'মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত'। আলস্নাহপাক বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করার জন্য শিক্ষা দিয়ে কোরআন শরিফে বলেছেন, 'রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগীরা' অর্থাৎ হে আলস্নাহ, আপনি আমার বাবা-মায়ের এমনভাবে লালন-পালন করুন যেমনিভাবে আমাদের বাবা-মা আমাদের লালন-পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ীও বাবা-মাকে ভরণ-পোষণ দিতে সন্তান বাধ্য থাকবে। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো বাবা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। অবহেলিত বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার জন্য সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ আইন প্রণয়ন করে। বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন। আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণ-পোষণ করতে হবে না। ওই আইনের ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তার সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩-এর ৬ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অপরাধগুলো আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য। ভুক্তভোগী চাইলে আপসের মাধ্যমে মীমাংসা করতে পারবে। কোনো সন্তান যদি আইন অনুযায়ী বাবা-মা বা দাদা-দাদি অথবা নানা-নানিকে ভরণ-পোষণ না দেয় তবে ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এই আইনের ৭ ধারার বিধানমতে, এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। পরিশেষে বলব, এ অমানবিক বিষয় রোধকল্পে আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। আমাদের সবারই বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পরায়ণ হওয়া উচিত। লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট