যেখানে নারীরা বিয়ে করে স্বামীর পুরো পরিবারকেই!

আমি যখনই সুযোগ পেলাম বান্ধবী, বান্ধবী, বান্ধবী- কিংবা পরিবারের নারী সদস্য, সবার কাছ থেকে শুনে নিতে থাকলাম তাদের বিয়েপরবর্তী অভিজ্ঞতার বয়ান। বিশেষত যাদের বিয়ের পর স্বামীর জয়েন্ট ফ্যামিলিতে গিয়ে মানিয়ে নিতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে বেশি কথা বললাম। এক বছর পর যখন বিয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো এবং আমি একটি নতুন জীবন ও পরিবার পেলাম, সেখানে আমাকে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হলো ঠিকই, তবে আমি ক্রমশ থিতু হতে লাগলাম। কথোপকথনগুলো আমাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে খুবই সাহায্য করেছে, যেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আবার কিছু কিছু পরিস্থিতিতে আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে কোথায় পিছু হটতে বা চুপ থাকতে হবে। মোদ্দা কথা, ওইসব আলাপচারিতায় যে গল্পগুলো আমি শুনেছি, সেগুলো আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২২, ০০:০০

ম আইন ও বিচার ডেস্ক
বিয়ের পর নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকা নারীদের আমরা বলি, তারাই তো বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে আসা প্রথম ব্যক্তি নয়। তাদের আমরা বেয়াদব, অহংকারী আরও কত খেতাব দিই। বিয়ের পর কীভাবে বেডরুম সাজাতে হবে, কাপোল ফটোশুটের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা কোনগুলো, কিংবা হানিমুনে কোন দেশে যাওয়া যেতে পারে অনলাইনে এমন অসংখ্য গাইডলাইন পাওয়া যাবে। কিন্তু সম্ভবত এমন একটিও আর্টিকেল পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো নতুন পরিবারে গিয়ে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে! "আপনাকে আপনার পরিবার থেকে সরিয়ে এই নতুন পরিবারে নিয়ে আসা হচ্ছে। আপনার স্বামীর পরিবারে!" ন্যাশনাল ডেটাবেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথোরিটি (নাডরা)-র একজন কর্মকর্তা বললেন, আমি দেখলাম, আক্ষরিক অর্থেই তিনি একেকটা ডকুমেন্ট থেকে আমার আগের পদবি সরিয়ে দিচ্ছেন। 'এখন আপনি তাদের (স্বামীর) পরিবারের অংশ,' তিনি জানালেন। এসব কথা শুনে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম স্বাভাবিক থাকার। আমার স্বামী অবশ্য পরে মজা করে বলেছিল, বিয়ে পড়ানোর সময় কাজী সাহেব আমাকে যতটা না আবেগাপস্নুত করে দিয়েছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি দিয়েছেন নাডরার ওই অফিসার। এই একটি ঘটনাই আমাকে বিয়ের অনুষ্ঠানের এক বছর আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে উদ্বুদ্ধ করল। আমি যখনই সুযোগ পেলাম বান্ধবী, বান্ধবী, বান্ধবী- কিংবা পরিবারের নারী সদস্য, সবার কাছ থেকে শুনে নিতে থাকলাম তাদের বিয়েপরবর্তী অভিজ্ঞতার বয়ান। বিশেষত যাদের বিয়ের পর স্বামীর জয়েন্ট ফ্যামিলিতে গিয়ে মানিয়ে নিতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে বেশি কথা বললাম। এক বছর পর যখন বিয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো এবং আমি একটি নতুন জীবন ও পরিবার পেলাম, সেখানে আমাকে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হলো ঠিকই, তবে আমি ক্রমশ থিতু হতে লাগলাম। কথোপকথনগুলো আমাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে খুবই সাহায্য করেছে, যেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আবার কিছু কিছু পরিস্থিতিতে আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে কোথায় পিছু হটতে বা চুপ থাকতে হবে। মোদ্দা কথা, ওইসব আলাপচারিতায় যে গল্পগুলো আমি শুনেছি, সেগুলো আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। যেমন ধরুন, ২৭ বছর বয়সি এক সদ্যবিবাহিতা আমাকে বলেছিল, নতুন বাড়িতে তাকে নাকি পনির খেতে দেওয়া হয় না। কথাটা শুনতে যত অদ্ভুতই লাগুক না কেন, শতভাগ সত্যি। তার শ্বশুর নাকি একটা হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, পনির খেলে ক্যানসার হয়। আর সে কারণেই এমন নিষেধাজ্ঞা! 'তাই এখন আর আমরা পনির খেতে পারি না। আমরা যদি কোনো দিন ভুলেও চিজ অমলেট খেয়ে ফেলি, তৎক্ষণাৎ সব প্রমাণ লোপাট করতে হয়,' আমাকে বলছিল সে। আমার মুখে অবিশ্বাসের ছায়া দেখতে পেয়ে সে আরও যোগ করে, 'আমি কিন্তু সিরিয়াস। আমি স্মোকিং করছি এটা আমার শ্বশুর দেখে ফেললেও কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু পনির খাচ্ছি সেটা কোনোভাবেই তাকে দেখতে দেওয়া যাবে না।' এরপর আমরা খুব হাসলাম ব্যাপারটা নিয়ে। যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরকম অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারের সঙ্গে সে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে কীভাবে, তার উত্তরটা আমার মনে খুব জোরে নাড়া দিল' এটা যে ওর (ওই নারীর স্বামীর) বাড়ি।' দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একটি আর্টিকেল থেকে জানতে পারলাম, ইউনিভার্সিটি অব কেনটাকির ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিকেশন নাকি সদ্য-বিবাহিতা নারীদের ডিপ্রেশন নিয়ে দুটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। ২০১৬ সালে হওয়া একটি গবেষণায় অংশ নেয় ২৮ জন নারী। তাদের মধ্যে অর্ধেকই জানিয়েছে, বিয়ের পর তারা আশাহত হয়েছে বা ডিপ্রেসড অনুভব করেছে। এছাড়া ২০১৮ সালে ১৫২ জন নারীকে নিয়ে অনুষ্ঠিত আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, ১২ শতাংশ নারীই বিয়ের পর ডিপ্রেশনে ভুগছে। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ নারীর মনোজগতে বিয়ের মাত্র কয়েক সপ্তাহ বা মাস বাদেই ডিপ্রেশন হানা দেয়। মাহিন নামের ৩০ বছর বয়সি এক নারী বলে, 'একবার যখন আপনি হানিমুন থেকে ফিরে ডিনার শেষ করবেন, জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করবে। আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন অন্য কারও বাড়িতে এবং ভাবতে থাকবেন, আচ্ছা বেশ, আমি নিজের বাড়িতে যাব কবে! অথচ এটিও কিন্তু আপনার একটা বাড়ি, কিন্তু একই সঙ্গে তা নয়।' ২৯ বছর বয়সি হেনাকে অবশ্য শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, স্বামীর বাড়ি আসলে তার নিজের বাড়ি নয়। 'আমি একটা খুবই রক্ষণশীল সমাজ থেকে এসেছি, যেখানে মেয়েদের খুব কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। আমার বেশ মনে আছে, আমার বয়স তখন ২১ বছর, আর আমার শাশুড়ি প্রথম দিনই আমাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, এটা আমার নিজের বাড়ি নয়,' হেনা জানায়। আমি যখন হেনাকে জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে তাকে এরকম একটা কথা বলা হয়েছিল, সে হাসতে হাসতে বলল, 'ওহ, তিনি ( হেনার শাশুড়ি) আক্ষরিক অর্থেই আমাকে বললেন, এটা আমার বাড়ি নয়, এটা তাদের বাড়ি, এবং আমাকে তাদের বেঁধে দেওয়া সব নিয়মকানুনই মেনে চলতে হবে।' দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হেনার এই অভিজ্ঞতা খুব একটা বিরল নয়। পাকিস্তান কিংবা সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় একজন নারীর জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে আসা মানে কেবল স্বামীর সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করাই নয়। এর মানে প্রায়ই এমন যে, আপনাকে একটি নতুন পরিবারে 'অ্যাডজাস্ট' করতে হবে। খাওয়া-দাওয়া, ব্যক্তিগত অভ্যাস থেকে শুরু করে সাধারণ জীবনাচার, সবখানেই পরিবর্তন আনতে হবে। তাছাড়া একটা অঘোষিত নিয়মও রয়েছে- স্বামীর বাড়ির আবহকে পাল্টে দিতে যেয়ো না, বরং নিজেকে পাল্টাও! একজন 'ভালো' পুত্রবধূর বৈশিষ্ট্য হলো: সে কম জায়গা দখল করবে, নিজের মনের কথা মুখ ফুটে বলবে না এবং শুধু স্বামী নয়, বরং স্বামীর পুরো পরিবারেরই আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। ২৯ বছর বয়সি ডেন্টিস্ট সিদ্রা তার স্বামীর সঙ্গে একটি ঝগড়ার স্মৃতিচারণা করে। সে বলে, দেবরকে সকালের খাবার দেওয়া প্রসঙ্গে নাকি ওই ঝগড়ার সূত্রপাত। 'ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, আমার তাকে খাবার বেড়ে দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে বলে, ধর্মে না থাকলেও, এটাই নাকি তাদের সংস্কৃতি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। ঘরের বাইরে কাজ তো আমিও করি। স্বামীর আগেই আমাকে আমার কর্মস্থলে পৌঁছাতে হয়। তারপরও স্বামীর কাজকর্ম করে দেওয়ার ব্যাপারে আমি কখনো অভিযোগ তুলিনি। কিন্তু তার ভাইয়ের কাজকর্মও যে আমিই করব, তা হতে পারে না। কিন্তু আমাদের বাদানুবাদ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, পরদিন আমি আমার মায়ের কাছে চলে যাই।' সিদ্রার পরিস্থিতিকে খানিকটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আদতেই, পাকিস্তানে ধর্মের চেয়েও এগিয়ে রাখা হয় সংস্কৃতিকে। 'আমাকে শুধু আমার স্বামীর দেখভাল করলেই হবে না, তার বাবা-মায়ের দেখভালও করতে হবে। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার মেজাজ গরম করে দেয়। আমার শাশুড়ির জায়গায় যদি আমার নিজের মা থাকতেন, তাহলে সবসময় আমার ওপর নির্ভর করে না থেকে তিনি বরং আমাকে আমার কাজে সাহায্য করতেন,' গত বছর বিয়ে করা সামরা আমাকে ফোনে জানায়। 'যখন বলা হয় শাশুড়ি তোমার মায়ের মতো, সেটা আসলে একটা ফাঁকি। শাশুড়ি কখনো মা হয় না।' যখন আমি আমার বান্ধবী আমিনার কাছে জানতে চাইলাম, নতুন বউ হিসেবে আমাকে কোন উপদেশটি সে দেবে, সে আমাকে বলল, 'তুমি তোমার নিজের মতো থাকো। আমি নিজে তা থাকতে পারিনি। আমার শ্রেষ্ঠ সংস্করণ হয়ে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। কিন্তু এতে আবার আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হতাশ হয়েছে। তাই শুরু থেকেই নিজের মতো থাক। তাদের কোনো সুযোগ দিও না অভিযোগ হলো বিয়ের পর তুমি বদলে গেছ।'