বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের শাসন বনাম আইনানুগ ব্যবহার লাভের অধিকার

মাদক ধ্বংসের পর ঘটনাস্থলেই জব্দকৃত নমুনা আলামত আদালতের অনুমতি নিয়ে ৫২২ রেগুলেশনের বিধান অনুসারে রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য পাঠাতে হবে এবং কিছু আলামত আদালতে প্রদর্শনীর জন্য কোর্ট মালখানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যে নম্বরে মালখানায় কথিত বস্তুগুলো গ্রহণ করেছেন সেই কোর্ট মালখানা রেজিস্টার (সিএমআর) অভিযোগ পত্রের ৬নং কলামে উলেস্নখ করতে হবে। কোর্ট মালখানায় প্রেরিত কথিত মাদকদ্রব্যগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারার বিধান অনুসারে বিচারিক আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

ব্রিটিশরা যখন তাদের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, দক্ষতাসহ নানা সমারোহ ঘটিয়ে প্রায় পুরো পৃথিবী শাসন করছিল, তখন তাদের প্রয়োজনে অসংখ্য আইনও তৈরি করেছিল। ১৮৯৮ সালে নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধি হাসিলের জন্যই তৈরি হয়েছিল ফৌজদারি কার্যবিধি। এর মূলনীতি হলো সাক্ষী প্রমাণ দ্বারা আসামি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। আরেকটি নীতি হলো, বিচারের ক্ষেত্রে কোনো আবেগ, অনুভব কিংবা বিশেষ কোনো ধারণা গ্রহণ করা যাবে না বা এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে এবং মামলার সাক্ষীসহ বিষয়বস্তু বিবেচনা করে আইন অনুসরণ করে রায় প্রদান করতে হবে।

একই সুরে আমাদের উচ্চ আদালত বিচারিক কাজকে স্বর্গীয় কাজ হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং এরূপ কাজ থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হলো স্বর্গীয় কাজ থেকে সরে দাঁড়ানোর শামিল।

কোনো ফৌজদারি মামলার ঘটনা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি কোনো ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি করে তাহলে আইনানুযায়ী সেই সন্দেহের সব সুবিধা আসামিপক্ষ পেতে হকদার। তবে যে সব কারণে মামলার ঘটনা সম্পর্কে সাধারণত সন্দেহের সৃষ্টি করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, এজাহারের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, আসামির কাছে থেকে উদ্ধারকৃত আলামত জব্দ তালিকার সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী না হওয়া, আসামির দাখিলীয় কাগজাদি বাদীর অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ হওয়া।

তবে মনে রাখতে হবে, মামলা প্রমাণের দাবি বাদীর। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আসামিকে তার নির্দোষিতা প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। প্রসিকিউশন পক্ষকেই আসামির অপরাধ প্রমাণ করতে হবে, ব্যর্থতায় আসামি খালাস পেতে হকদার। সাক্ষ্য প্রমাণাদি পরীক্ষার পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামি কর্তৃক উপস্থাপিত ব্যাখ্যা সত্য হওয়ার যৌক্তিক সম্ভাবনা আছে তাহলে আদালতের এরূপ অভিমত সম্পূর্ণ মামলায় প্রভাবিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে আসামি তার অধিকারবলে সন্দেহের সুবিধা লাভের অধিকারী। (রনি আহম্মেদ লিটন বনাম রাষ্ট্র, ৬১ ডিএলআর (এইচসিডি) ১৪৭)।

কারণ, ফৌজদারি আইনবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র হচ্ছে, যদি দুটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির সাক্ষ্যে বাস্তব বিষয়টি উত্থাপিত হয় তার মধ্যে একটি আসামির দোষ এবং অপরটি নির্দোষ সম্পর্কিত। তাহলে আদালতের উচিত আসামির পক্ষাবলম্বন করা।

একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য স্থানে তলস্নাশি করা হোক কিংবা বাড়ি ঘরে সবক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অফিসারকে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অফিসারকে একটি জিডি মূলে কোনো স্থানে বা স্থাপনায় প্রবেশ করতে হয় কিংবা প্রকাশ্য স্থান থেকে মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনের অপরাধে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করতে হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর ২১ এবং ২৩ ধারার বিধান অনুসরণ করতে হয়।

এরপর পুলিশ বিভাগের বাইবেল বলে খ্যাত পি আর বি'র ২৮০ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে কোনো স্থান তলস্নাশি করার জন্য প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই পুলিশ অফিসার নিজের কাছে কিছু নেই তা উপস্থিত সাক্ষী কর্তৃক প্রবেশের পূর্বেই করাতে হবে। নতুবা নিজেদের বহন করা মাদকদ্রব্য দিয়ে যে কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারার বিধান অনুসারে কমপক্ষে স্থানীয় গণ্যমান্য দুইজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে তলস্নাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পি আর বি ও ফৌজদারি কার্যবিধির এ দুটি ধারার বিধান অনুসারে তলস্নাশিতে উদ্ধারকৃত বস্তুগুলো ঘটনাস্থলে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং ঘটনাস্থলেই জব্দ ও নমুনা আলাদা করতে হবে এবং সেগুলোকে জব্দকারী অফিসার ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য যুক্ত লেভেল দ্বারা সিলগালা করতে হবে যাতে পরবর্তী সময়ে এগুলোর মধ্যে কোনরুপ অপরাধমূলক দ্রব্য প্রবেশ করানো না যায়।

জব্দকৃত কথিত মাদকদ্রব্য থানার অফিসার-ইন চার্জ এর নিকট জমা দিতে হবে এবং সেগুলো অবশ্যই থানার প্রপার্টি রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে মাদকের পরিমাণ বেশি হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে সংরক্ষণ করা অসুবিধাজনক হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা যাবে। (সেকশন ২৯(২)। আর যদি এমন হয় যে, মাদকের পরিমাণ এত বেশি যে যেগুলো থানা পর্যন্ত পরিবহণ করা অসুবিধাজনক, সেক্ষেত্রে ঘটনাস্থলেই সেগুলো ধ্বংস করা যাবে। (সেকশন ২৯(৩)।

মাদক ধ্বংসের পর ঘটনাস্থলেই জব্দকৃত নমুনা আলামত আদালতের অনুমতি নিয়ে ৫২২ রেগুলেশনের বিধান অনুসারে রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য পাঠাতে হবে এবং কিছু আলামত আদালতে প্রদর্শনীর জন্য কোর্ট মালখানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যে নম্বরে মালখানায় কথিত বস্তুগুলো গ্রহণ করেছেন সেই কোর্ট মালখানা রেজিস্টার (সিএমআর) অভিযোগ পত্রের ৬নং কলামে উলেস্নখ করতে হবে। কোর্ট মালখানায় প্রেরিত কথিত মাদকদ্রব্যগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারার বিধান অনুসারে বিচারিক আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।

মাদকের এই পথ পরিক্রমায় সংবাদপ্রাপ্তি, তলস্নাশি, উদ্ধার, জব্দ, রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য প্রেরণ, ধ্বংস, নমুনা মালখানায় প্রেরণ, আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা- এগুলোর মধ্যে যদি কোনো একটি ব্যত্যয় ঘটে অর্থাৎ আসামিপক্ষ থেকে যদি এগুলোর কোনো একটির অভাব উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে আসামিকে খালাস দিতে হবে। কারণ উচ্চ আদালত বলছেন, সন্দেহের সুবিধা আসামি পাইতে হকদার ও অধিকারী, মোটেই আদালতের দয়া নয়।

আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে, মানুষের জীবন, সম্পত্তি, সুনাম বা স্বাধীনতার হানিকর কোনো কার্য আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে গ্রহণ করা যাবে না। কাজেই আইন যেভাবে বলছে ঠিক সেইভাবে আইনী ব্যবহার লাভ প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হয়ে উঠুক, সংবিধানের বাণী চিরন্তন রূপ লাভ করুক।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।

ই-মেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে