সড়ক পরিবহণ আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কতদূর

সড়ক পরিবহণ আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা দন্ডবিধি-১৮৬০-এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পালস্না দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদন্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে এটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আইনটি পাস হওয়ার পর পরই এটি পরিবর্তনের দাবিতে পরিবহণ শ্রমিকরা দুই দফায় ধর্মঘট ডাকে। ফলে আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সংশোধনীতে রয়েছে এই আইনের-১০৫ ধারা অনুযায়ী, কেউ যদি মোটরযান দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন বা মারা যান, তাহলে তা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে।

প্রকাশ | ১০ মে ২০২২, ০০:০০

ম অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দীন খালেদ
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুজন শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দেওয়ার পর দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহণ আইন পাস করে। এর আগে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং মোটরযান বিধিমালা ১৯৮৪-এর অধীনে সড়ক পরিবহণ খাত পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১ নভেম্বর ২০১৯ ইং থেকে 'সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮' কার্যকর করার জন্য ২২ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এরপর বিআরটিএ থেকে আইনটি কার্যকর করতে সবার কাছে অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে 'আইন মেনে চালাব গাড়ি, নিরাপদে ফিরব বাড়ি'। সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ এ মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলি দেওয়া হয়েছে। ওই আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে- মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোন চালক মোটরযান চালাতে পারবে না। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবে না। মোটরযান চালক কোনো অবস্থাতে কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত অভিমুখ ব্যতীত বিপরীত দিক হতে মোটরযান চালানো যাবে না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে বা উল্টো পার্শ্বে বা ভুল দিকে (ডৎড়হম ঝরফব) মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্য কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। চালক ব্যতীত মোটর সাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবে না এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো যাত্রীকে মোটরযানে উঠাতে বা নামাতে পারবে না। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহণে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। মোটরযানের বডির সামনে, পেছনে, উভয়পার্শ্বে, বডির বাহিরে বা ছাদে কোনো প্রকার যাত্রী বা পণ্য বা মালামাল বহন করা যাবে না। সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোনো মোটরযানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবে না। কোন মহাসড়ক, সড়ক, ফুটপাত, ওভারপাস বা আন্ডারপাসে মোটরযান মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ বা মালামাল রেখে বা দোকান বসিয়ে বা অন্য কোনোভাবে দ্রব্যাদি রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। সড়কের সংলগ্ন ফুটপাতের উপর দিয়ে কোনো প্রকার মোটরযান চলাচল করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি কোনো মোটরযানের মালিক বা কোনো আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবে না। দ্বিতীয় অংশ : মোটরযান চালক মোটরযান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবে না। মোটরযান চালক সিটবেল্ট বাঁধা ব্যতীত মোটরযান চালাতে পারবে না। দূরপালস্নার মোটরযানে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোনো যাত্রী বা আরোহী বহন করা যাবে না। কোনো চালক, কমান্ডার বা মোটরযান পরিচালনার সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি পরিবহণযানে যাত্রী সাধারণের সঙ্গে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবে না। রাত্রির বেলায় বিপরীত দিক হতে আগত মোটরযান চালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়- এরূপ হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবে না। উপরোক্ত নির্দেশাবলিসমূহ অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রথম অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৩(তিন) মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। দ্বিতীয় অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ১ (এক) মাসের কারাদন্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। নতুন আইনে বেপরোয়া বা অবহেলায় গাড়ি চালানোর কারণে কেউ গুরুতর আহত বা কারো প্রাণহানি হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সড়ক পরিবহণ আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা দন্ডবিধি-১৮৬০-এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পালস্না দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদন্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে এটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আইনটি পাস হওয়ার পর পরেই এটি পরিবর্তনের দাবিতে পরিবহণ শ্রমিকরা দুই দফায় ধর্মঘট ডাকে। ফলে আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সংশোধনীতে রয়েছে এই আইনের-১০৫ ধারা অনুযায়ী, কেউ যদি মোটরযান দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন বা মারা যান, তাহলে তা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে। দন্ডবিধির ৩০৪-বি ধারায় যা-ই বলা থাকুক না কেন- কারো নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি চালানোর ফলে বা অবহেলাজনিত কারণে কেউ যদি দুর্ঘটনার শিকার হন এবং এতে যদি কেউ মারা যান বা মারাত্মকভাবে আহত হন, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড কিংবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি হবে। কিন্তু সংশোধনীতে 'মারাত্মকভাবে আহত' বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং জরিমানা ৩ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, পাঁচ বছর কারাদন্ডের বিষয়টি রাখা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীকে জরিমানার টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দিতে পারবেন। আইনের ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা অজামিনযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনটি সংশোধন হলে ৮৪ ও ৯৮ ধারা জামিনযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ৮৪ নম্বর ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শান্তির কথা বলা হয়েছে। ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে- যার মধ্যে ১৫টি ধারায় বিদ্যমান কারাদন্ড ও অর্থদন্ড কমানো হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার আরো বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে; কারণগুলোর মধ্যে রাস্তার বস্ন্যাকস্পট (ত্রম্নটি), অদক্ষ চালক, সড়কের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, রাস্তার জ্যামিতিক ত্রম্নটি, ঘুমন্ত ও নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, পথচারী ও যাত্রীদের অসাবধানতা, ডিভাইডারের অভাবে বিপরীতমুখী যানবাহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ, রেলের অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। অনেক সময় রেলক্রসিংগুলোতে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছে মানুষ। দেশের অধিকাংশ রেলক্রসিংয়ে নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা, নেই কোনো সঠিক আগাম সংকেতের ব্যবস্থাও। দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে দ্রম্নত চিকিৎসা সাহায্য পৌঁছানো, এম্বুলেন্স, ইমার্জেন্সি সার্ভিস এবং ফার্স্ট এইড টিম সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো দেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হাইওয়েগুলোতে পুলিশের পেট্রোল কারের সংখ্যাও নগণ্য। গাড়ির সিটবেল্ট এবং হেলমেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা, ঝুঁকিপূর্ণ গতিতে গাড়ি ওভারটেক করা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। যানবাহনের দ্রম্নতগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসেও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিরোধ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিআরটিএ'র উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ট্রাকে ওভারলোড বন্ধে প্রয়োজনীয়সংখ্যক (ওয়েয়িং) মেশিন চালু করা এবং ওভারলোডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিভিন্ন সড়কের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা বিরোধী অভিযান চালাতে হবে। সড়ক মেরামত, সংস্কারের মতো জরুরি কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে সাধারণ জনতা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা ভুলে যাচ্ছে এটা কোনো সঠিক পন্থা নয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সড়ক পরিবহণ আইন এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা দরকার। সড়কে যানবাহন চলাচল এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোতে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা অবিলম্বে সম্পন্ন করা হোক। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু, সমন্বিত পদক্ষেপ, জনগণের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা। লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট