কথায় বলে, 'নেই কাজতো খই ভাজ'। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের আইনজীবীদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা, যৌক্তিক-অযৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক, ভোট প্রার্থনা, আবেগ উত্তাপ, মৃতু্য, অসুস্থতা চলছে। আগামী ২৫ মে পর্যন্ত এবং তারপরও কিছুদিন চলতে থাকবে, চলাটাই স্বাভাবিক। আমরা যে হুজুগে বাঙালি।
আইন পেশায় এসে আইনাঙ্গনের নানা জনের নানা বক্তব্য শুনেছি, পড়েছি, জেনেছি, উপলব্ধি করেছি। আরও জেনেছি বার ও বেঞ্চকে তুলনা করা হয় রথের সঙ্গে। রথ চলে দুই চাকায় ভর করে। যে কোনো একটি চাকা না চললে রথ চলতে পারে না।
শুরুতেই বলে রাখি বার কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান কাজ হলো আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়ন করা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাতে হয় আইনজীবীদের পেশাগত মানোন্নয়নে বার কাউন্সিল গত ৫০ বছরে এমন কি করেছে- যা বুক, মুখ উঁচিয়ে বলতে পারেন?
ব্রিটিশ-ভারত থেকেই আইনজীবী পরীক্ষা চালু ছিল। দি লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট-১৯৭২ অনুযায়ী আইনজীবীদের সনদ তথা আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনজীবীদের হাতেই ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কতিপয় প্রতিনিধি এর অসততা ও অদক্ষতায় সনদের পরীক্ষায় অনেক অনিয়ম হওয়া শুরু হলো এবং যাকে খুশি ইচ্ছে মাফিক আইনজীবী সনদ দেয়া শুরু হলো।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বার কাউন্সিলের এসব আইনজীবী নেতৃত্ব যখন ধারাবাহিকভাবে আইনজীবী সনদ নিয়ে অসততা প্রদর্শন করল, ঠিক তখনই দি লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট-১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ১১(১) (বি), দি লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার অ্যান্ড বার কাউন্সিল (সংশোধনী)-২০১২ এবং অনুচ্ছেদ ১১(খ) প্রতিস্থাপন করা হলো। ফলশ্রম্নতিতে নতুন করে আইনজীবী তালিকাভুক্তি কমিটি পুনর্গঠিত হলো- যার সদস্য সংখ্যা ৫ জন।
তারা হলেন, একজন-চেয়ারম্যান (আপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি মহোদয়দের থেকে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক নির্ধারিত), দুইজন সদস্য (হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি মহোদয়দের থেকে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক নির্ধারিত) একজন সদস্য (এটর্নি জেনারেল), একজন সদস্য (বার কাউন্সিলের সদস্য থেকে)।
আবার বার কাউন্সিলের ভোটার তালিকায় গুরুতর অনিয়মের বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর বাইরে এনরোলড আইনজীবীদের মূল তালিকার শুদ্ধতা ও বৈধতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলতে চাই। এখানে বিপুলসংখ্যক 'নন-প্র্যাকটিসিং' সদস্য রয়েছেন। কাউন্সিল ৫০ বছরেও 'নন-প্র্যাকটিসিং ল'ইয়ার্স লিস্ট' তৈরি করতে পারেনি।
এনরোলমেন্ট বা সদস্যভুক্তির সময় একজন আইনজীবী হলফ করে বলেন, আমি অন্য কোনো পেশায় নেই। কিন্তু পরে অনেকেই পেশা বদলান, অনেকেই নিয়মিত প্র্যাকটিসে থাকেন না। অথচ ২০০৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বার 'একবার-এক ভোট' বিধান চালু করে। অথচ অমাদের বার সমিতির নির্বাচন টাকা বানানোর খেলায় পরিণত হয়েছে। তারা তাই যত খুশি তত সংখ্যায় বারের সদস্য বানায়। এক দিনের জন্য এরা ভোট দিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। বার সমিতি 'মানিব্যাগ দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার'। প্র্যাকটিসিং আইনজীবীরা প্রায়ই বলে থাকেন, 'নন-প্র্যাকটিসিং অ্যাডভোকেটরা' কেবল ভোটের বাজারের ফড়িয়া হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। বার নির্বাচন তার প্রতিনিধিত্বশীল বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে।
বার কাউন্সিলের উদ্দেশ্যে বলছি, আসুন, প্রতি বছর তালিকা হালনাগাদ করি। এটা প্রকাশের আগে প্রতি বছর জুলাই মাসে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আইনজীবীরা তাদের পেশায় সক্রিয় থাকার জানান দেবেন। তালিকায় আইনজীবীর ছবিও মুদ্রিত হবে- যা বার কাউন্সিলের সচিব সত্যায়িত করবেন। কে সক্রিয় আইনজীবী আর কে ঘুমন্ত আইনজীবী, তা নিরূপণের মানদন্ড নির্ণয় করতে হবে।
তালিকাভুক্তরা না হয় প্রতি বছর ঘোষণা দিলেন, চাঁদাও শোধ করলেন, কিন্তু কারা নন-প্র্যাকটিসিং আর কারা প্র্যাকটিসিং তা কী করে বুঝব। আইনজীবীরা তাদের পেশাগত বার্ষিক ঘোষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বছরে তাদের দ্বারা ওকালতনামা স্বাক্ষরিত মামলাগুলোর একটি তালিকা দেবেন। আইনজীবী তার মাসিক সদস্য চাঁদা তার ব্যাংক হিসাবের অনুকূলে চেকে পরিশোধ করবেন। আয়কর রিটার্ন জমা দেবেন। এসব শর্ত পূরণ করে যারা বার্ষিক বিবৃতি দিতে ব্যর্থ হবেন, তাদের সদস্যপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টাররা প্রতি ঘণ্টার প্র্যাকটিসের রেকর্ড সংরক্ষণ করেন। আর আমাদের দেশে অনেকে হাইকোর্ট বারে এনরোলড হয়ে কুষ্টিয়া গিয়ে প্র্যাকটিস করেন। তাদের নাম ফলকে 'আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট' দেখে মানুষ বিভ্রান্ত হন।
অথচ আজ যিনি আইনজীবী, কাল তিনিই বিচারপতি। হাইকোর্টের বিচারক হতে সংবিধানে বলা আছে 'অনূ্যন ১০ বছরকাল অ্যাডভোকেট' বা একই সময় কোনো 'বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান' থাকলেই চলবে। যেহেতু ৯০ শতাংশের বেশি হাইকোর্টের বিচারক আইনজীবী কোটা থেকে আসেন, তাই বার কাউন্সিলের কার্যক্রমে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত থাকা দরকার। বার কাউন্সিলের আচরণবিধি বলছে, আইনজীবী পেশা 'মানি মেকিং ট্রেড' নয়। দক্ষতার ভিত্তিতে উপযুক্ত ফি নিতে হবে। মক্কেল ধনী হলেও বেশি টাকা নেওয়া বারণ।
২০০৩-এর পূর্বে প্রতি ৬ (ছয়) মাস অন্তর অন্তর বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট পরীক্ষা নেয়া হতো। ২০০৬/০৭-এর দিকে বছরে অন্তত একটি এনরোলমেন্ট পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন কি অবস্থা? কয় বছরে একটি পরীক্ষা নেয় হয়? আপনাদের কাজটা কি বলুন তো? আইনজীবীদের পেশাগত অসদাচারণের আবেদনও করতে হয় বার কাউন্সিলের সচিব বরাবর, যিনি একজন জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক।
সবিশেষ বার কাউন্সিলের নেতাদের প্রতি কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তরের প্রতীক্ষায় খোলা ময়দানে প্রশ্নগুলো ছেড়ে দিয়ে আইনজীবীদের শত্রম্নতে পরিণত হয়ে লেখাটি শেষ করলাম।
১। বিচার বিভাগকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে কোনকালেই আপনাদের কোনরূপ উলেস্নখযোগ্য ভূমিকার কথা বলতে পারবেন কি?
২। আইনজীবীদের সম্মান রক্ষা, আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কিনা?
৩। আইনজীবী সমিতি এবং আদালতকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে কি জাতীয় ভূমিকা পালন করেছেন?
৪। মৃতু্যর পর আপনার টাকা বানরের পিঠা ভাগ হবে। অথচ জীবদ্দশায় বেনাভোলেন্ট ফান্ডের টাকা নিয়ে কেউ কোনো ভূমিকা পালন করেছেন কি?
৫। অসুস্থ আইনজীবীকে চিকিৎসার জন্য কত টাকা দিয়েছেন?
৬। আপনাদের কাজ কি?
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
ইমেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স.