মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারকের দায়

আদালতের মাধ্যমে পরের জমি নিজের করে নেয়ার চর্চা আরও গতি পায়, যখন ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুর রেখে যাওয়া সম্পত্তি যখন পিয়ারা পাকিস্তানের আইয়ুব খান শত্রম্ন সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়, তখন ফরিদপুরের টেপাখোলা গরুর হাটের সংজ্ঞা নিয়ে কোর্টে তো লড়াই করবেই মোহন মিয়া। ফলে শত্রম্ন সম্পত্তি নিজের করে নেওয়ার জন্য আদালতের বারান্দাই হলো শেষ ভরসা। করিমকে রাম সাজিয়ে করে দিল মামলা, আপসে রায়ও হলো, শুধু বারাসাতে থাকা রাম জানলো না কীভাবে তার সম্পত্তি পাশের বাড়ির প্রতিবেশী নিয়ে গেল। ফলে ১৯০৮ সালের ঔপনিবেশিক আমলের তৈরি দেওয়ানি কার্যবিধি হয়ে উঠলো কিছু মুসলিম লীগারের পরের জমি আপন করে নেওয়ার অস্ত্র

প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২২, ০০:০০

শেখ মো. মুজাহিদ উল ইসলাম
কোনো একটি মামলা (দেওয়ানি বা ফৌজদারি) নিষ্পত্তিতে কেন দেরি হয়, সে বিষয়ে বিচারকের দায় বা কতটুকু বা কোনো বিচারক চাইলেই কি মামলা দ্রম্নত নিষ্পত্তি করতে পারে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা না দিলে আইন অঙ্গনের বাইরের লোকদের ভুল ধারণা থেকেই যাবে। তাই চেষ্টা করছি কেন একটি মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়, তার কারণগুলো তুলে ধরতে এবং এ দায় কার তা খুঁজে বের করতে। এই আলোচনায় ঐতিহাসিক ও নৃতাত্মিক কারণগুলোও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব বলে আশা করি। বাংলাদেশে দেওয়ানি মামলার মধ্যে সিংহভাগই জমি সংক্রান্ত মামলা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জাতিগতভাবে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনোভাবে মামলাপ্রবণ ছিল না। আজও বেশির ভাগ বয়স্ক লোকদের কাছ থেকে শোনা যায় যে, আগে জমি বেচাকেনা হতো মুখে মুখে, জমির ভাগবাটোয়ারা হতো মুখে মুখে। আজও কারও বাবা মারা যাওয়ার পরে কতজন নিজেদের সম্পত্তি বণ্টন দলিল করে নেয়, তার হিসাব কজন রাখে। যাই হোক, মূলতো জমির জরিপ শুরু হয় ১৯ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ রাজের হাত ধরে- যা বহুলভাবে সি এস রেকর্ড নামে পরিচিত- যা আজও সব চাইতে নির্ভুল খতিয়ান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত জমি বেচাকেনার কাগুজে ভিত্তি তারপর হতে শুরু হয়- যা আজও বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্ব বহন করে, জমির মালিকানার প্রমাণ হিসেবে। যেহেতু ব্রিটিশ রাজের অধীনে জমিদারই ছিল জমির মালিক, তাই সাধারণ জনগণ যে বেশি আদালতমুখী ছিল, তার প্রমাণ আমার জানা নেই। ফলে জমিদার দ্বন্দ্ব মিটাতে আমাদের প্রিয় ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির কার্যকারিতা নিয়ে বেশি সমস্যা হয়নি। ফলে সেই সময়ের বিচারে ভাওয়াল রাজের দুই স্ত্রীর দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রিভি-কাউন্সিল পর্যন্ত যেতেও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সাধারণ মানুষ তার প্রজা স্বত্ব নিয়েই খুশি ছিল। সমস্যা হলে জমিদারই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতেন। তারপর জিন্নাহর পিয়ারা পাকিস্তানে বুদ হয়ে পেলাম পাকিস্তান। ঝঅঞ অপঃ, ঘঅঞ অপঃ দিয়ে জমিদারি প্রথা হলো বিলোপ, প্রজা হয়ে গেল মালিক। দ্বিজাতি ফর্মুলার মাধ্যমে যে পাকিস্তানের জন্ম হলো ১৯৪৭ এ, সেখানে শুধু দুটো রাষ্ট্রই জন্ম নেয়নি, সঙ্গে গ্রামের নওজোয়ানরা নিজেদের হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে নতুন করে নিজেদের আবিষ্কার করল। মাঝখান দিয়ে ছুরি চালানো বাংলা ও পাঞ্জাবে ঘটলো ভয়াবহ দাঙ্গা- যা শুধু কলকাতা বা নোয়াখালীর রাস্তায় রক্ত গঙ্গাই বইয়ে দিল না, সেই সঙ্গে কোটি কোটি মানুষকে করল ভিটেমাটি হারা। ওপার থেকে এপারে এলো অনেক মুসলমান, আবার এপার হতে ওপারে গেল অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। গেল তো গেল, কিন্তু ভিটেমাটি, নবাবপুর রোড বা ওয়ারীর বাড়ি তো রয়ে গেল, যার দিকে দৃষ্টি পড়লো নব্য শিক্ষিত মুসলিম লীগের ধজা ধরা নেতাদের, লক লক করে উঠলো জিহ্বা। নতুন পাকিস্তান হবে মুসলিম লীগার মোহাম্মদ আলীদের, ফজলুল কাদের চৌধুরীদের, সম্পত্তি কেন হবে না? তাদের স্বপ্নে বুদ হয়ে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেল সে লকলকে জিহ্বার জালের বিস্তার। শুরু হলো পাকিস্তান আমলে চেয়ারম্যানের (মৌলিক গণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট) কাচারিতে বসে বানানো এসএ খতিয়ানের প্রস্তুতি। যারা মোটামুটি মুসলিম লীগের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান তারা এস এ খতিয়ানে নাম ঢুকিয়ে জমি নিল দখলে। কিন্তু জমির মালিক হওয়ার উপায় তো দরকার। গেল তহশিল অফিসে, জিজ্ঞাসা করে উপায় কি আছে? তহশিলদার দেখালো সহজ পথ, খাজনা বাকি ফেলে, আদালত হতে নিলাম কেনেন, তা না হলে ভিটেমাটি ছাড়া মূল মালিকের নামে করেন মানি সুট (টাকা পাওয়ার মিথ্যা দাবিতে)। এরপর ডিক্রি নিয়ে জারি মামলা করিয়ে হয়ে যান সম্পত্তির মালিক; আদালত থেকে দলিল করে নেন। এভাবে নানা পথ বাতলে দিল সেই সময়ের ৫ ক্লাস বা আট ক্লাস পড়া তহশিলদার। ফলে দেখা গেল, যখন খুলনার জব্বার মিয়া রাজশাহী কোর্টে যেয়ে হরিপদ শাহার বিরুদ্ধে মিথ্যা মানি সুট দায়ের করে একতরফা রায় করাচ্ছে, তখন হরিপদ হাবড়ার গলিতে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে বাসা খুঁজছে। কোর্টে জব্বার মিয়া ৫ জন সাক্ষী দাঁড় করিয়ে আদালতকে একতরফা রায়ের জন্য চাপ দিতে থাকে, তখন আদালত কয়েক তারিখ অপেক্ষা করে, তার পক্ষে একতরফা রায় দিতে বাধ্য হয়। আদালতের মাধ্যমে পরের জমি নিজের করে নেয়ার চর্চা আরও গতি পায়, যখন ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুর রেখে যাওয়া সম্পত্তি যখন পিয়ারা পাকিস্তানের আইয়ুব খান শত্রম্ন সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়, তখন ফরিদপুরের টেপাখোলা গরুর হাটের সংজ্ঞা নিয়ে কোর্টে তো লড়াই করবেই মোহন মিয়া। ফলে শত্রম্ন সম্পত্তি নিজের করে নেওয়ার জন্য আদালতের বারান্দাই হলো শেষ ভরসা। করিমকে রাম সাজিয়ে করে দিল মামলা, আপসে রায়ও হলো, শুধু বারাসাতে থাকা রাম জানলো না কীভাবে তার সম্পত্তি পাশের বাড়ির প্রতিবেশী নিয়ে গেল। ফলে ১৯০৮ সালের ঔপনিবেশিক আমলের তৈরি দেওয়ানি কার্যবিধি হয়ে উঠলো কিছু মুসলিম লীগারের পরের জমি আপন করে নেওয়ার অস্ত্র। \হএকথা মনে রাখা উচিত, এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই ভালো এবং মামলাবাজ না। ফলে যখন দেওয়ানি আদালতে চলছে এ রকম ছলাকলার মাধ্যমে মুসলিম লীগারদের অঢেল সম্পদ বানানোর বা সবুর খান হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, তখন এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তান খেদাও আন্দোলনে। সম্পত্তি নিয়ে তাদের ছিল না মাথাব্যথা। তাইতো তৎকালীন ধানমন্ডি ইউনিয়নের ৩২নং সড়কের জায়গা নিতে যেয়ে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের যখন হিমশিম খেতে হয়, তখন ফজলুল কাদের চৌধুরী বা সবুর খানরা করে ফেলেছেন অঢেল টাকা। যাইহোক, আদালতকে ব্যবহারের সে ঢেউ যখন গ্রামগঞ্জে লেগে গেল, তখন প্রত্যেক গ্রামে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের ফসল পরিষদ চেয়ারম্যানরা হয়ে উঠলো এক একটা ছোটখাটো খান এ সবুর। শুধু তো হিন্দুর জমি দখল করে উদরপূর্তি হয়নি। সাহেবের তো পাশের বাড়ির নিরীহ আব্দুলের জমিও লাগবে। নানা চাপ দিয়ে যখন পারে না, তখন এক দিন আব্দুলকে ভয় দেখাল। আব্দুল সাহস নিয়ে আদালতে গেল জমির মালকানা চেয়ে। সাহেব তো জানে আব্দুলই মালিক। তখন সাহেব চিন্তা করল, ক'দিন আর সে কোর্টে যাবে, সুতরাং মামলাটা একটু ঘুরালেই কাজ হয়ে যাবে। আর আব্দুলের নামে একটা চাঁদাবাজির মামলা দিলেই আর একটা নাম করা উকিল ধরলেই কাজ হয়ে যাবে। যে কথা সেই কাজ। আব্দুলের দেওয়ানি মামলা দায়েরের প্রথম তারিখ পরে সমন ফেরতের তারিখ পড়ল। কিন্তু সাহেব আর হাজির হয় না। সব প্রসেস শেষ করে যখন বিচারক তারিখ দিলেন রায় দেয়ার, তখন সাহেব হাজির জবাব নিয়ে। এরপরে মামলার প্রসেস আবার নতুন করে শুরু হলো। এর মধ্যে সাহেব আদালতে দরখাস্ত দিয়ে বললো যে আব্দুল দিচ্ছে হুমকি (যা সম্পূর্ণ মিথ্যা), সেটা আদালত বুঝে সেই দরখাস্ত খারিজ করল। তার বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে করল আপিল, তাই শুনানি হতে লাগল আরও কিছু দিন। জেলা জজ আদালত করল না মঞ্জুর। সেখান থেকে সাহেব আরও বড় উকিল ধরে গেল হাইকোর্ট, আর আব্দুল বউয়ের কানের দুল বেচে গেল হাইকোর্টে। ধরলাম হাইকোর্টও আব্দুলের পক্ষে রায় দিল। তারপর সাহেব গেল প্রধান বিচারপতির দরবারে। সেখানেও ধরলাম সিদ্ধান্ত হলো আব্দুলের পক্ষে। এত কিছু করতে যেয়ে সময় লাগলো ধরলাম ১০ বছর। কিন্তু তারপরও মামলা আবার শুরু হতে শুরু হলো। মাঝখান দিয়ে আব্দুল হলো সর্বস্বান্ত। আর ধরলাম সাহবের হলো ২০ হাজার টাকা জরিমানা। মোটকথা যেটা বলার চেষ্টা করছি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি করা দেওয়ানি কার্যবিধির প্রয়োগের মাধ্যমে যদি কোনো পক্ষ চায় যে কোনভাবেই সে মামলা ঘুরাতে পারে, যেখানে বিচারক বা আদালত বুঝলেও কিছু করতে পারে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কোনো বিচারকের কারণে মামলার দেরি হয় না, মামলার দেরি হয় দখলবাজদের বংশধরদের ঔপনিবেশিক চিন্তাচেতনার দেওয়ানি কার্যবিধির সুযোগগুলোর অপব্যবহারের কারণে, আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনার চরম দুবর্লতার কারণে, জমি জরিপের নামে নয় ছয়ের কারণে, বোনের সম্পত্তি ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতার কারণে, একই জমি একাধিক লোকের কাছে বিক্রির কারণে, বন্ধকি সম্পত্তি অপরজনের কাছে বিক্রির কারণে, মিথ্যা মামলা করে খুব সামান্য জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার কারণে। মাও সেতুংয়ের বিপস্নবের পর দীর্ঘ দিনের গবেষণার পর ১৯৮০-এর দশকে তারা তাদের দেওয়ানি কার্যবিধির প্রণয়ন করে, তাদের দেশের মানুষের প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গতি প্রকৃতিকে মাথায় রেখে এবং আজও তা সংশোধন করেই যাচ্ছে। সুতরাং, আসলেই যদি মামলা দ্রম্নততার সঙ্গে নিষ্পত্তি চাই, তবে আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে জংধরা অপারেশনের ছুরি দিয়ে অপারেশন করলে, রোগীতো ভালো হবেই না, উপরন্তু যেখানে অপারেশন হয়েছে, ওখান থেকে নতুন করে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। আর হবে ডাক্তারের বদনাম। শেখ মো. মুজাহিদ উল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, বর্তমানে পরিচালক (প্রশাসন), বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট।