চাই শিশুবান্ধব আদালত

শিশু আইনে বিশেষায়িত শিশু আদালত গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যার দায়িত্বে থাকবেন অতিরিক্ত দায়রা জজ সমপযাের্য়র একজন বিচারক। এই আদালত প্রথাগত আদালত থেকে হবে ভিন্নতর, যেখানে আদালতের ভাবগাম্ভীযর্ বজায় না রেখে শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। লিখেছেন আবরার মাসুদ

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আমাদের দেশে শিশু আইন প্রথম প্রণীত হয় ১৯৭৪ সালে। দীঘর্ প্রায় ৪০ বছর যাবত ওই আইনটির অধীনেই পরিচালিত হয়েছে শিশু-কিশোরদের বিচারকাজ ও পুনবার্সনপ্রক্রিয়া। ২০১৩ সালে এসে শিশু আইনটি আবারও নতুন করে প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইউনিসেফসহ নানা আন্তজাির্তক সংস্থার সহায়তা ও পরামশর্ক্রমে শিশু আইনটি নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়। ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইনটিতে বলা হয়েছে, আইনের সঙ্গে সংঘষের্ জড়িত শিশু কিংবা আইনের সংস্পশের্ আসা শিশু যে মামলাতেই থাকবে সেই মামলার বিচার হবে শিশু আদালতে। এখানে ‘আইনের সঙ্গে সংঘষের্ জড়িত শিশু’ বলতে শিশু আসামিকে বোঝানো হয়েছে। আর ‘আইনের সংস্পশের্ আসা শিশু’ বলতে অপরাধের শিকার শিশু বা শিশু সাক্ষীকে বোঝানো হয়েছে। শিশু আইনে বিশেষায়িত শিশু আদালত গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যার দায়িত্বে থাকবেন একজন অতিরিক্ত দায়রা জজ সমপযাের্য়র একজন বিচারক। এই আদালত প্রথাগত আদালত থেকে হবে ভিন্নতর, যেখানে আদালতের ভাবগাম্ভীযর্ বজায় না রেখে শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। শিশু আইনে যা আছে : শিশু আইন অনুসারে, ২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৬(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিটি জেলা সদরে এবং ক্ষেত্রমতো মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে একটি করে শিশু আদালত থাকবে। এক বা একাধিক অতিরিক্ত দায়রা জজের আদালতকে শিশু আদালত হিসেবে নিধার্রণ করে বিচারকাযর্ পরিচালনা করতে হবে। আইনের ১৭(১) ধারা অনুযায়ী আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশু বা আইনের সং¯পশের্ আসা শিশু কোনো মামলায় জড়িত থাকলে যেকোনো আইনের অধীনেই হোক না কেন, ওই মামলা বিচারের এখতিয়ার থাকবে কেবল শিশু আদালতের। ১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, সাধারণত যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, সেটা ছাড়া, যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবতের্ একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে। শিশু আদালত বাস্তবায়নের উদ্যোগ : এরকম আদালত বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ব্যতিক্রমধমীর্ আদালতকক্ষ গড়ে তোলার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। শিশু আইনেই বলে দেয়া আছে, শিশু আদালতের পরিবেশ কেমন হবে, বিচারক, পুলিশ, আদালতের কমর্কতার্-কমর্চারীরা অফিশিয়াল ড্রেস পরতে পারবে না। কিন্তু এগুলো এতদিন ধরে প্রতিপালন হচ্ছিল না। ইউনিসেফের সহায়তায় এজন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সাধারণত আমাদের প্রথাগত আদালতগুলোতে লালসালু মোড়ানো এজলাস, কালো গাউন বা আলখেল্লা ও সাদা শাটর্ ও টাই পরা বিচারক এবং আইনজীবী, অস্ত্র হাতে পোশাক পরা পুলিশ থাকে। এই পরিবেশ শিশুদের জন্য ভীতিকর। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু নিবিের্শষে সব আসামিকেই এমন পরিবেশে আদালতে হাজির করা হয়ে থাকে। মামলায় জড়িত হলেই এ ধরনের পরিবেশ দেখতে অভ্যস্ত সবাই। এ চিরাচরিত সাধারণ নিয়ম পাল্টে শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে শিশুবান্ধব আদালত। যেখানে থাকবে না সাধারণ আদালতের মতো লালসালু মোড়ানো এজলাস, পোশাক ও অস্ত্রধারী পুলিশ, ডক ও কাঠগড়া, গাউন পরা বিচারক ও আইনজীবী। আদালত কক্ষের পরিবেশই হবে অনেকটা ঘরোয়া ও পারিবারিক। শিশুদের জন্য থাকবে বিভিন্ন ধরনের খেলনা, বেলুন, বিভিন্ন ধরনের চকলেট, বিস্কুট ও বসার জায়গা। অভিভাবকদের উপস্থিতি থাকবে ঘরোয়া পরিবেশের মতো। কোনো মামলায় আসামি বা সাক্ষী হিসেবে শিশুদের মানসিক চাপমুক্ত রাখতে ২০১৩ সালের শিশু আইনের বাস্তবায়ন করতে পুরোদমে কাজ করছে সরকার। সারাদেশে এ ধরনের ১৫টি আদালতের কাযর্ক্রম চলছে। শিগগিরই এসব আদালতের উদ্বোধন করা হবে। সুপ্রিম কোটর্ সূত্রে জানানো হয়েছে, আদালতকে ভীতিমুক্ত এবং শিশু আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দীঘির্দন ধরে কাজ করে আসছে সরকার। সেই হিসেবে ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি শিশু অধিকারবিষয়ক সুপ্রিম কোটের্র বিশেষ কমিটি এবং ইউনিসেফ (জাতিসংঘ শিশু তহবিল) বাংলাদেশ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশু আদালত হিসেবে নিধাির্রত আদালত কক্ষগুলোকে শিশু আইনের দিকনিদের্শনা অনুযায়ী শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলা। আইনের আওতায় আসা শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিশু আইন অনুযায়ী ব্যতিক্রমভাবে সাজানো হচ্ছে শিশু আদালতের কক্ষ। এ সমঝোতা স্মারকের আওতায় প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ঢাকা মহানগর ও জেলায় দুটি, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় দুটি, খুলনা মহানগর ও জেলায় দুটি, সিলেট মহানগর ও জেলায় দুটি, রাজশাহী মহানগর ও জেলায় দুটি এবং রংপুর বিভাগে একটি, ময়মনসিংহ জেলায় একটি, যশোর জেলায় একটি, কক্সবাজার ও বরিশাল জেলায় একটি করে শিশুবান্ধব আদালত কক্ষ তৈরি হচ্ছে। নিধাির্রত এসব আদালতে বিচারকাযর্ চলাকালে উকিল ও বিচারকের গায়ে থাকবে না নিধাির্রত গাউন। পুলিশ বা আদালতের কোনো কমর্চারীও পেশাগত বা দাপ্তরিক কোনো পোশাক পরতে পারবে না। আদালতকক্ষের পাশেই থাকবে একটি ওয়েটিং রুম (অপেক্ষমাণ কক্ষ)। এ ছাড়া থাকবে একজন প্রবেশন কমর্কতার্র কক্ষ। ওয়েটিং রুম ও প্রবেশন কমর্কতার্র কক্ষ সাজানো হচ্ছে বিভিন্ন চিত্রকমর্ দিয়ে। অভিযুক্ত শিশুরা সাবর্ক্ষণিক প্রবেশন কমর্কতার্র সান্নিধ্য ও সহায়তা পাবে। বিচারকাজ শুরুর আগে শিশু তার বাবা-মা বা অন্য অভিভাবকের সান্নিধ্যে অপেক্ষা করতে পারবে। ফলে অন্যান্য আদালতে আনীত বয়স্ক অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে এসব শিশুর সংমিশ্রণের সুযোগ থাকবে না। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোটের্র বিশেষ কমর্কতার্ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, শিশু আইনের বিধান অনুযায়ী শিশুবান্ধব শিশু আদালত গড়ে তোলা হচ্ছে। এ কাজের জন্য শিশু অধিকারবিষয়ক সুপ্রিম কোটের্র বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলীসহ কমিটির অন্য সদস্যরা প্রতিটি বিভাগীয় শহরে পরিদশর্ন করে পুলিশ, সমাজসেবা কমর্কতার্, বিচারকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামশর্ সভা করেছেন। শিশু আইনের বিধান মেনে কীভাবে শিশু আদালতের পরিবেশ শিশুবান্ধব করা যায়, সে ব্যাপারে তারা দিকনিদের্শনা দিয়েছেন। কার কী দায়িত্ব হবে, কীভাবে আইনের আওতায় আসা শিশুদের শিশুবান্ধব পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিচার স¤পন্ন করা যাবে, শিশু আইন অনুযায়ী আদালত কক্ষগুলো কেমন হবে এসব বিষয়ে তারাই দিকনিদের্শনা দিয়েছেন। তাদের নিদের্শনার আলোকেই মোট ১৫টি আদালত শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে। খুব শিগগিরই ঢাকা ও চট্টগ্রামের আদালত কক্ষগুলোর উদ্বোধন করা হবে। শিশু আদালতের কাযর্ক্রম নিয়ে মনিটরিং করা সুপ্রিম কোটের্র ¯েপশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৩ সালে আইন তৈরি হলেও এর বিধি বিধানগুলো সেভাবে মানা হচ্ছিল না। শিশু আইনের বাস্তবায়ন করতেই মূলত এ আইন করা হয়েছে।