ভারতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন ইউ ইউ ললিত

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

আইন ও বিচার ডেস্ক
ভারতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের নাম প্রস্তাব করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রমণা। নিয়ম মেনেই ভারতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি উদয় উমেশ (ইউ ইউ) ললিতের নাম প্রস্তাব করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রমণা। ২৬ অগস্ট অবসর নিতে চলেছেন দেশটির বর্তমান প্রধান বিচারপতি রমণা। তার অবসরের পরই দেশের ৪৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২৭ আগস্ট শপথগ্রহণ করবেন ললিত। প্রধান বিচারপতি হিসেবে ললিতই হবেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থেকে সরাসরি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতি এবং পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হবেন। এর আগে ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি এস এম সিকরি শীর্ষ আদালতের আইনজীবী থেকে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং পরে প্রধান বিচারপতি হন। বিচারপতি ললিত একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। রমণার উত্তরসূরি হিসেবে ললিত এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়ে বহুবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন ললিত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার পর থেকে বিতর্কিত 'তিন তালাক' মামলাসহ একাধিক যুগান্তকারী মামলায় রায় দিয়েছেন ললিত। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চ ২০১৭ সালের আগস্টে 'তিন তালাক' প্রথাকে অকার্যকর, অবৈধ এবং অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এই সাংবিধানিক বেঞ্চের সদস্য ছিলেন ললিত। তিনজন বিচারপতি বিশেষ সম্প্রদায়ের এই বিবাহবিচ্ছেদ প্রথার বিপক্ষে রায় দেন। ললিতও রায় দেন বিপক্ষেই। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার এবং বিচারপতি এস আবদুল নাজির এই রায়কে ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার পক্ষে ছিলেন। পাশাপাশি এই বিষয়ে সরকারকে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার কথাও বলেন তারা। তখন বিচারপতি কুরিয়ান জোসেফ, আর এফ নরিমান এবং ললিত এই প্রথাকে 'সংবিধানের লঙ্ঘন' বলে উলেস্নখ করে এই প্রথার বিপক্ষে রায় দেন। বিচারপতি ললিতের নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ রায় দিয়েছিল, ত্রিবাঙ্কুরের রাজপরিবারেরই কেরালার ঐতিহ্যবাহী পদ্মনাভস্বামী মন্দির পরিচালনার অধিকার রয়েছে। একদা দেশীয় রাজ্য ত্রিবাঙ্কুরের ভারতভুক্তির সময় থেকেই ওই মন্দির পরিচালনার ভার ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবার কর্তৃক নিযুক্ত এক আধিকারিকের হাতে ছিল। তবে ২০০৯ সালে পদ্মনাভস্বামী মন্দির পরিচালনার জন্য ট্রাস্ট গড়ার নির্দেশ চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন এক আইনজীবী। ২০১১ সালে কেরালা হাইকোর্ট সে রাজ্যের সরকারকে মন্দির এবং মন্দিরের সম্পত্তির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি ট্রাস্ট তৈরির নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবারসহ নানা শিবির। সমগ্র কেরলজুড়ে বিতর্কের ঢেউ ওঠে। সমগ্র পরিস্থিতি বিচার করে কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবারের হাতে রাখার পক্ষে রায় দেন বিচারপতি ললিত। রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ত্রিবাঙ্কুর রাজপরিবারের প্রয়াত রাজা চিথিরা থিরুনাল বলরাম বর্মার মৃতু্যর পরে পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের সেবায়েত হওয়ার অধিকারী তার ভাই মার্তন্ড বর্মা এবং তার উত্তরাধিকারীরাই। ২০২১-এর জানুয়ারি মাসে বম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের বিচারপতি পুষ্প গানেদিওয়ালা রায় দিয়েছিলেন, শিশুদের পোশাক খুলে বা জামাকাপড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তাদের বুক বা গোপনাঙ্গ স্পর্শ না করা হলে 'শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইন' (পকসো) আইনে তাকে যৌন নির্যাতন বলে ধরা হবে না। বোম্বে হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। বিচারপতি গানেদিওয়ালার রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা করা হয় শীর্ষ আদালতে। এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে উঠলে বিচারপতি ললিত, বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভট্ট এবং বিচারপতি বেলা ত্রিবেদীর বেঞ্চ বম্বে হাইকোর্টের এই রায় খারিজ করে দেন। সুপ্রিম কোর্ট বম্বে হাইকোর্টের ওই রায়কে 'অযৌক্তিক' বলে জানায়, যৌন নিগ্রহের অপরাধের ক্ষেত্রে সরাসরি ত্বকের স্পর্শ জরুরি নয়, যৌন অভিপ্রায় আছে কিনা, তা বেশি জরুরি। তিন বিচারপতির বেঞ্চ বম্বে হাইকোর্টের ওই রায়কে 'সঙ্কীর্ণ পর্যবেক্ষণ' বলেও উলেস্নখ করে। রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার জন্য সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চেও ছিলেন বিচারপতি ললিত। এই বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। তবে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি অর্থাৎ যে দিন এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা ছিল, সে দিন শুনানির শুরুতেই নিজেকে এই মামলা থেকে সরিয়ে নেন ললিত। শুনানির শুরুতেই মসজিদ পক্ষের আইনজীবী রাজীব ধওয়ন বিচারপতি ললিতের বেঞ্চের সদস্য থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আইনজীবী ধওয়ন দাবি করেন, ১৯৯৭ সালে বিচারপতি ললিত নিজেও বিতর্কিত বাবরি মসজিদ মামলার আইনজীবী ছিলেন। সে সময় তিনি এক পক্ষের হয়ে মামলাও লড়েছিলেন। তাই বিচারপতি ললিতের বেঞ্চে থাকা উচিত হবে না, বলেও তিনি উলেস্নখ করেন। তার সঙ্গে সহমত হন অন্যান্য বিচারপতিরাও। এর পরই এই সাংবিধানিক বেঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন বিচারপতি ললিত। ওই একই বেঞ্চের সদস্য ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি রমণাও। ২জি স্পেক্ট্রাম কান্ড মামলায় ললিতকে সিবিআই-এর সরকারি আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। বিচারপতি ললিত ১৯৫৭ সালের ৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালের জুন মাসে তিনি আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বম্বে হাইকোর্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি দিলিস্ন হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে তাকে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে একজন বলিষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে মনোনীত করা হয়। সূত্র : আনন্দবাজার