মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদির চিঠি, আত্মবিশ্বাস ও মুক্তির গল্প

উঘঅ ঞবংঃ-এর মাধ্যমে কনডেম সেল থেকে মুক্তির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার ইনোসেন্ট প্রকল্পের তথ্যানুসারে ১৯৮৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৭৫ জন ব্যক্তি উঘঅ ঞবংঃ-এর মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, ৩৭৫ জন ভুল ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ২১ জন ছিলেন যারা কনডেম সেলে মৃতু্যর প্রহর গুনছিলেন এবং তারা গড়ে ১৪ বছর করে কারাগারে ছিলেন। আমরা এরূপ বিচারকে বলি মিসক্যারেজ অব জাস্টিস

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ম সাইফুল ইসলাম পলাশ
৪৬ বছর পর আসামির পুনঃবিচার শুরু হয়েছে। এই ৪৬ বছর তিনি জামিনে ছিলেন না; ছিলেন কনডেম সেলে। কনডেম সেল মানে জানেনতো! এই সেলে মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্তদের কারাগারের অন্যান্য কয়েদিদের থেকে আলাদা একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়। মৃতু্যদন্ড রায় শোনার পর ৪৬ বছর অর্থাৎ ১৬৩৭৬ দিনের প্রত্যেকটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত তিনি মৃতু্যর প্রহর গুনছেন। আর এই দীর্ঘ সময় কনডেম সেলে থাকার কারণে তিনি গিনেজ রেকর্ড করে ফেলেছেন। এখন ধারণা করা হচ্ছে তিনি প্রকৃত আসামি নন। অত্যন্ত মর্মান্তিক এই রেকর্ডধারী ব্যক্তির নাম হাকামাদা ইওয়াও। হাকামাদা একজন জাপানি নাগরিক এবং একজন খ্যাতনামা বক্সার। ঘটনার সময় তিনি বক্সিং ছেড়ে একটি সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিতে যোগ দেন। ঘটনাটা ১৯৬৬ সালের ৩০ জুন। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাত ২টার সময় তার কোম্পানির মালিক হাশিমোতোর বাড়িতে আগুন জ্বলছিল। প্রতিবেশীদের আহ্বানে চারটি ফায়ার ট্রাক এসে আগুন নেভালেন। ঘটনাস্থলটি ঠান্ডা হওয়ার পর সেই বাড়িতে চারটি লাশ পাওয়া যায়। লাশগুলো হাশিমোতো, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের। তাদের শরীরে পেট্রোলের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল এবং ৪০ বারের বেশি ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। পুলিশ এসে আরো জানলেন হত্যাকারী সেই বাড়ি থেকে ২ লাখ ইয়েন লুট করে পালিয়ে যান। সে সময় প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় হেডলাইন। পুলিশ ঘটনা তদন্তে ৮০ জনের একটি স্পেশাল ফোর্স গঠন করল। সেই দল ঘটনাস্থল থেকে একটি ৫.১চ্ বেস্নডযুক্ত ছুরি খুঁজে পেল। ধারণা করা হলো, এই ছুরি দিয়েই হত্যাকারী চারজনকে খুন করেছেন। পুলিশ হাকামাদার কক্ষ থেকে একটি রক্তমাখা পায়জামা জব্দ করে। ধারণা করা হলো পায়জামায় মিশ্রিত রক্তের গ্রম্নপ নিহত পিতা-পুত্রের রক্তের গ্রম্নপের সঙ্গে মিলেছে। সেই পায়জামায় প্রচুর গ্যাস ও তেলের চিহ্ন খুঁজে পায়। এটিকে পুলিশ প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে যে হাকামাদাও অগ্নিসংযোগ করেছে। ঘটনার ২৯ দিন পর হাকামাদাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত তিনটি কারণে তাকে পুলিশের সন্দেহ হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমত, তার ধষরনর (ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে অনুপস্থিতির অজুহাত) ছিল না। তিনি ওই কোম্পানির ডর্ম রুমে একাই বাস করছিলেন এবং তিনি আগুন নেভানোর জন্য প্রতিবেশী ও অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তার বাম হাতের মাঝের আঙুল এবং ডান কাঁধে কাটা ছিল। কিন্তু হাকামাদা বলেছিলেন তিনি আগুন নেভানোর সময় ছাদ থেকে পড়ে জখমপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তৃতীয়ত, তিনি একজন বক্সার ছিলেন। সে সময় জাপানে একটা বক্সার বিরোধী কুসংস্কার ছিল। এসব কারণে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২৩ দিনের রিমান্ডে নিলেন। আমাদের দেশের সঙ্গে জাপানি ফৌজদারি আইনের পার্থক্য হচ্ছে এখানে পুলিশ একনাগাড়ে ১৫ দিনের অধিক জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন না (সিআরপিসি ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারা)। কিন্তু জাপানে একনাগাড়ে ২৩ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। হাকামাদা টানা ২০ দিন জিজ্ঞাসাবাদের মাথায় তিনি হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করলেন। হাকামাদা বিচারের সময় সেই দোষ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, তাকে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়েছিলেন। কারাগারে থাকাবস্থায় এক চিঠিতে লিখেছিলেন- 'পুলিশ আমাকে এই বলে হুমকি দিয়েছিল যে, তারা আমাকে হত্যা করলে তাদের কিছুই হবে না। কারণ তারা তার অসুস্থতাজনিত কারণে মৃতু্য হয়েছে মর্মে রিপোর্ট করবে। আমাকে উপহাস করা হয়েছিল এবং কাঠের নাইটস্টিক দিয়ে পেটানো হয়েছিল। দিনের পর দিন আমাকে দুই তিন জন শিফটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কোনো কোনো রাতে রাত ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমাকে পালাক্রমে লাথি মেরেছে। এই ছিল আমার জিজ্ঞাসাবাদ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বীকারোক্তি আদায় করা যে, আমি খুন করেছি এবং অগ্নি সংযোগ করেছি। যদিও আমি এমন কিছু করিনি।' কোন পরিস্থিতিতে তিনি এই স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় কারাগার থেকে লেখা আরেকটি চিঠিতে। তিনি লিখেছিলেন- 'যখন আপনাকে একই জিনিস বারবার এবং বারবার বলা হয়, তখন এটি আপনাকে বিরক্ত করে। এক সময়ে আপনি যখন শারীরিক ব্যথা অনুভব করবেন, তখন আপনি মনে করবেন যে আপনি যা করেননি তা বললে পরিস্থিতি থেকে পালাতে পারেন। মানুষ কী এমন হয় না!' ২. ১৯৬৬ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর। সেদিন হাকামাদার বিরুদ্ধে শিজুওকা জেলা আদালতে হত্যাসহ দসু্যতা ও অগ্নি সংযোগের অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলার বিচার চলাকালে বিচারের ১৭তম অধিবেশনে একটি অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে। প্রসিকিউটরা ঘোষণা দেন, পুলিশ এইমাত্র ঘটনাস্থলের মিসো ট্যাংক থেকে ০৫টি পোশাক জব্দ করেছেন। এখন আর পূর্বে উদ্ধারকৃত পায়জামা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এই পোশাকগুলো গুরুত্বপূর্ণ- যা হাকামাদা হত্যাকান্ডের পর মিসো ট্যাংকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। নতুনভাবে সংযোজিত এই আলামতগুলো মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এতকিছুর পরেও তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আদালত সত্যকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাকে খালাস দেবে। ১৯৬৭ সালে তার মাকে পাঠানো এক চিঠিতে লিখেছিলেন- 'অবশ্যই এই মামলার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মা, পিস্নজ তুমি আত্মবিশ্বাসী হও এবং তোমার মাথা উঁচু করে এখানে জেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো।' সে বছর তিনি আরেকটি চিঠিতে লিখেছিলেন- 'আমি নির্দোষ। আমি শান্তভাবে আমার বিচার শেষ করার অপেক্ষা করছি।' ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮। সেদিন ছিল হাকামাদার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিন। সেদিন বিচারিক আদালতে তাকে মৃতু্যদন্ডে দন্ডিত করা হয়। রায় শোনার পর তার আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরে। কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়েননি। এরপর হাকামাদা এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে টোকিও হাইকোর্টে আপিল করলে তা নামঞ্জুর হয়। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে তাও নামঞ্জুর হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি পুনর্বিচারের আবেদন করলে তাও সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত নামঞ্জুর হয়। তিনি ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় বারের মতো পুনর্বিচারের দরখাস্ত দেন। ৩. বিচারিক আদালতে এই মামলার বিচারক ছিলেন ০৩ জন। কুমামতো নরিমিচি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। ২০০৭ সালে তিনি একটা বিস্ফোরক তথ্য দিলেন। জানালেন, তিনি মৃতু্যদন্ড দেওয়ার জন্য রাজি ছিলেন না। যেদিন মামলায় নতুনভাবে আলামত সংযোজন হয়েছে সেদিনই তিনি অনুমান করেছিলেন আসামি নির্দোষ। তিনি প্রথমে ৩৫০ পৃষ্ঠার খালাসের রায়ের খসড়া লিখেছিলেন। কিন্তু অন্য দু'জন সিনিয়র বিচারক তাকে মৃতু্যদন্ডের রায় লিখতে বাধ্য করেছিলেন। এজন্য তিনি সারাটা জীবন ভীষণ অনুশোচনার মধ্যে ছিলেন। এই রায় ঘোষণার পর বিচারকের জীবন পাল্টে গিয়েছিল। রায় ঘোষণার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৯। সে সময় সবাই ধারণা করেছিলেন তিনি একদিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হবেন। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে রায় ঘোষণার মাত্র ছয় মাস পরে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর শুরু হয় তার যন্ত্রণাদায়ক জীবন। তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন। পারকিনসন্স ও ক্যানসারসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন অ্যালকোহলিক জীবনেও। এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কুমোমোটো বারবার বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন তিনি একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে মৃতু্যদন্ড দিতে সাহায্য করেছিলেন। বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগের পর তিনি চারবার হাকামাদার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেননি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তিনি আসামিপক্ষের আইনজীবীর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন তাকে যেন হাকামাদার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে আপিল আদালতে উপস্থিত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। সেই চিঠির উত্তর তিনি পাননি। ৪. আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে ছয়টি প্রধান যুক্তি প্রদর্শন করে হাকামাদার খালাস চাইলেন। এগুলো হলো- প্রথমত: হাকামাদার স্বীকারোক্তি মিথ্যা ছিল। আইনানুসারে শুধু সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত স্বীকারোক্তি গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া জাপান সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো ব্যক্তিকে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না যদি তা বাধ্যবাধকতা, নির্যাতন বা হুমকির মাধ্যমে হয় বা গ্রেপ্তার বা ডিটেনশনের দীর্ঘদিন পর করা হয়। শুধু নিজের স্বীকারোক্তি দ্বারা কাউকে বাধ্য করা যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে বলি, জাপানের দোষ স্বীকারোক্তি বিষয়ে সেখানকার সমাজবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক ডেভিড জনসন মনে করেন, দীর্ঘকাল ধরে দোষ স্বীকারোক্তি জাপানি ফৌজদারি বিচারের মূল ভিত্তি। এখানে স্বীকারোক্তিকে বলা হয় 'প্রমাণের রাজা (করহম ড়ভ বারফবহপব)' এবং 'প্রমাণ নির্ধারক উপাদান' যা প্রত্যেক প্রসিকিউটর দ্বারা চাওয়া হয়। এমনকি বেশির ভাগ বিচারক দ্বারা তা প্রত্যাশিত। আর এই প্রত্যাশার কারণে স্বীকারোক্তিগুলো প্রায়ই দীর্ঘ, নিবিড় এবং কখনো কখনো জবরদস্তিমূলক হয়। বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে ২০০ ঘণ্টার বেশি জিজ্ঞাসাবাদের পরে প্রাপ্ত একটি স্বীকারোক্তি অনৈচ্ছিক, অবিশ্বস্ত এবং প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। এই মামলায় হাকামাদাকে ২৩ দিনে প্রায় ২৬৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত: ফ্যাক্টরি ট্যাংক থেকে জব্দকৃত রক্তমাখা কাপড়ের সঙ্গে আসামির কোন সংযোগ ছিল না। প্যান্টের সাইজ ছোট ছিল। প্রথমে প্রসিকিউশনের ধারণা ছিল ট্যাংকে ভেজানো ছিল বলে সাইজ ছোট ছিল এবং প্যান্টে লেখা ই মানে ইরম সাইজ। কিন্তু পরে দেখা গেছে ই মানে ইষধপশ; তৃতীয়ত: একজন আসামির দ্বারা চারজন ব্যক্তিকে ৪০টির বেশি জখম করা হলে প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনতে পেত; চতুর্থত: হত্যার একমাত্র অস্ত্র ছোট্ট ছুরিটি ভিকটিমদের শরীরে অতটা গভীর জখম সৃষ্টি করতে পারেনি; পঞ্চমত: যে রাস্তা দিয়ে হাকামাদা প্রবেশ করেছিল মর্মে দাবি করা হয়েছিল তা বাস্তবে তালাবদ্ধ এবং দুর্গম ছিল; ষষ্ঠত: এই হত্যাকান্ডের পেছনে আসামির কোনো মোটিভ ছিল না। প্রসিকিউশন টাকা লুট করাকে আসামির উদ্দেশ হিসেবে দাবি করলেও সেখানে থাকা ৩,৭৪০,০০০ ইয়েন, চেক বই, স্টক সার্টিফিকেট এবং দামি গয়না নেওয়া হয়নি। ৫. হাকামাদা কনডেম সেলে থাকাবস্থায় ২০১১ সালে নিজের ৭৫তম জন্মবার্ষিকীতে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেললেন। এই রেকর্ড সুখকর নয়, বরং মর্মান্তিক। তিনি দীর্ঘ সময় যাবত কনডেম সেলে থাকার গিনেজ রেকর্ড করেছেন। কনডেম সেলের দিনগুলো কেমন ছিল তা তার বিভিন্ন চিঠিতে ফুটে উঠেছে। আমি সেগুলো চিঠির বর্ণনা দেব না। প্রসঙ্গক্রমে আরেকজন কনডেম সেলে থাকা কয়েদির অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। এই ভদ্রলোকের নাম সাকাই মেন্ডে। তিনি ১৯৪৯ সালে একটি ডাবল মার্ডার কেসে মৃতু্যদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। কিন্তু ৩৪ বছর কনডেম সেলে থাকার পর পুনঃবিচারে মাধ্যমে খালাস পেয়েছিলেন। এই মামলাতে তার দোষ স্বীকারোক্তি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জাপান সরকার তাকে প্রতিদিনের জন্য ৭০০০ ইয়েন করে মোট ৯০ মিলিয়ন ইয়েন ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে- 'সকাল ৮:০০টা থেকে ৮:৩০টা সময়টা ছিল সবচেয়ে জটিল সময়। কারণ এই সময়টাতে মৃতু্যদন্ড কার্যকর করার ব্যাপারে অবহিত করা হয়। এ সময় আপনি সবচেয়ে ভয়ানক উদ্বেগ অনুভব শুরু করবেন। কারণ আপনি জানেন না কারারক্ষীরা কখন আপনার সেলের সামনে এসে থেমে যাচ্ছে। এই অনুভূতিটা কতটা ভয়ংকর তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি তখন আমার মেরুদন্ডের নিচে কাঁপুনি অনুভব করতাম। এটা একেবারেই অসহনীয় ছিল'। এমন ভাবেই প্রতিটা দিন কাটে কনডেম সেলে। বিচারিক আদালতে মৃতু্যদন্ড দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হয় না। মৃতু্যদন্ডের চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে কয়েক বছর লেগে যায়। কিন্তু রায় ঘোষণার পরপরই তাকে কনডেম সেলে থাকতে হয়। ৬. পুনর্বিচারের আবেদনের পর হাকামাদার মামলায় জব্দকৃত পোশাকগুলোর উঘঅ ঞবংঃ করা হলো। পরীক্ষায় দেখা গেল সেই হত্যাকান্ডের ঘাতকের পোশাকে যার উঘঅ আছে তা হাকামাদার নয়। এরূপ প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন মঞ্জুর করা হলো এবং তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপরেও প্রসিকিউশন ওই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায়। কিন্তু সর্বশেষ ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বিচারের আদেশ বহাল রাখেন। উঘঅ ঞবংঃ-এর মাধ্যমে কনডেম সেল থেকে মুক্তির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার ইনোসেন্ট প্রকল্পের তথ্যানুসারে ১৯৮৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৭৫ জন ব্যক্তি উঘঅ ঞবংঃ-এর মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, ৩৭৫ জন ভুল ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ২১ জন ছিলেন যারা কনডেম সেলে মৃতু্যর প্রহর গুনছিলেন এবং তারা গড়ে ১৪ বছর করে কারাগারে ছিলেন। আমরা এরূপ বিচারকে বলি মিসক্যারেইজ অব জাস্টিস। বর্তমান বিশ্বের ১৪২টি দেশে শাস্তি হিসেবে মৃতু্যদন্ড না থাকলেও আমি এটাকে সমর্থন করি। উপযুক্ত ক্ষেত্রে অপরাধীকে অবশ্যই মৃতু্যদন্ড দিতে হবে। কিন্তু এই দন্ড প্রদানে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই দন্ড হতে হবে সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং কোনোভাবেই যেন এগুলোর বিকল্প ব্যাখ্যার সুযোগ না থাকে। এখন হাকামাদার বয়স ৮৬ বছর। বর্তমানে তিনি জাপানের ছোট্ট শহর হামামাতসুতে বোনের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু এই বয়সেও তিনি যে কোনো আবহাওয়ায় প্রতিদিন ৫/৬ ঘণ্টা করে হাঁটেন। একজন ভলান্টিয়ার তাকে অনুসরণ করেন যেন তিনি আঘাত না পান, যেন তিনি পথ হারিয়ে না ফেলেন। যে মানুষটি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন, আজ মুক্তির পর মুক্তধারার আলোয় অবিরত হেটে চলা যেন ৪৬ বছর বন্দিত্বের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ। (বি.দ্র. সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত এবং একাধিক বিদেশি জার্নাল থেকে অনূদিত) সাইফুল ইসলাম পলাশ, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ।