ভারতে সারোগেসি নিয়ন্ত্রণে নতুন আইনি কাঠামো

‘সাংসদ হিসেবে আরও একটা বিষয় তুলে ধরি। যেমন ধরুন, ১৯৫৬ সালে টেস্ট টিউব বেবির কোনো ধারণাই ছিল না। অনেক গবেষণায় মেডিকেল সায়েন্সের উন্নতি হয়েছে। সারোগেসিতে ভ্রæণ প্রতিস্থাপন করতে গেলে আগে তো টেস্ট টিউব বেবি তৈরি করতে হবে। সেজন্য টেস্ট টিউব বেবির নিয়ম-কানুন থাকা দরকার। সরকার সেটা করেনি। ফলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জেতার মতো অবস্থা, তাই না?’

প্রকাশ | ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভারতীয় সংসদে সারোগেসি নিয়ন্ত্রণ বিল পাস হয়েছে। পাস হওয়া বিলের বিধান অনুযায়ী, সন্তানহীন নিকট আত্মীয়ের জন্য বিনা লাভে সারোগেসি বৈধ। শতর্ হলো, নিঃসন্তান দম্পতিকে ডাক্তারি সাটিির্ফকেট দেখাতে হবে, তারা সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম। যিনি ধাত্রী মা হবেন, তাকে হতে হবে তাদের নিকট আত্মীয়। ফলে বিদেশি দম্পতিরা ভারতে এসে গভর্ ভাড়া নিতে পারবেন না। শুধু নিঃসন্তান দম্পতির নিকট আত্মীয় সারোগেট বা ধাত্রী মা হতে পারবেন. তবে শতর্ হবে, সেই দম্পতির বিবাহ পঁাচ বছর পার হয়ে গেছে এবং ডাক্তারি সাটিির্ফকেট অনুসারে ভবিষ্যতে দম্পতির সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সেই সারোগেসিতে টাকা-পয়সার লেনদেন থাকবে না। ভারতীয় দম্পতির আগে সন্তান থাকলেও তারা সারোগেসির সুযোগ নিতে পারবেন না। শুধু ভারতীয় দম্পতিরা ছাড়া বিদেশিরা গভর্ ভাড়া নিতে পারবেন না। এ ছাড়া সিঙ্গেল কিংবা লিভ-ইন পাটর্নার অথবা সমকামীদের ক্ষেত্রেও সারোগেসি নিষিদ্ধ। অনাবাসিক ভারতীয়রাও এরমধ্যে পড়বেন। সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় জোর তকর্-বিতকের্র পর ঐতিহাসিক সারোগেসি নিয়ন্ত্রণ বিলটি পাস হয়। বিলের বিভিন্ন সংস্থান নিয়ে কিছু কিছু আপত্তি ওঠে। তৃণমূল কংগ্রেসের কাকলি ঘোষ দস্তিদার বিলের পরিসর আরও বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। সংসদে রাখা তার বক্তব্য সম্পকের্ জানতে চাইলে সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানান, ‘সারোগেসির অপব্যবহার ভারতে অনেকদিন ধরেই চলছে। সারোগেসি কাকে বলে? যে মহিলা নিজের গভের্ সন্তান ধারণ করতে অক্ষম, তিনি একজন ধাত্রী মায়ের সাহায্য নিতে পারেন। মেডিকেল কারণে সেটা তো হতেই পারে। যেমন ধরুন, কারও ক্যান্সার হয়েছে, কারও ইউট্রাস নেই, কারও টিউমার আছে. এটা মেডিকেল সারোগেসির মধ্যে পড়ে। এটা অনুমোদিত। কিন্তু আসলে যা হচ্ছিল, বিদেশিরা ভারতে এসে টাকা দিয়ে গভর্ ভাড়া নিচ্ছে। এটা সব থেকে বেশি হয় গুজরাটের আনন্দ এলাকায়। গ্রামকে গ্রাম মহিলারা আসে এখানে গভর্ ভাড়া দিয়ে রোজগারের ধান্দায়। এদের স্বামী কিংবা বাড়ির অন্য কারোরই তেমন রুজি-রোজগার নেই। গভর্ ভাড়ার টাকাতেই তাদের জীবন নিবার্হ হচ্ছে। কিংবা গভর্ ভাড়া দেয়ার জন্য যে টাকাটা পাচ্ছে, ধরুন ৩-৪ লাখ টাকা, সেটা নিয়ে বাড়ির লোকেরা ব্যবসা শুরু করছে। কিন্তু সারোগেট মা তার কিছুই পাচ্ছে না। শুধু গভর্ ধারণের কষ্টটা ছাড়া।’ তিনি জানান, ‘এর আরও একটা দিক আছে। এজেন্সি বা দালালচক্র। তারা বিদেশি দম্পতির কাছ থেকে মোটা টাকা, ধরুন, লাখ দশেক নিল, কিন্তু সারোগেট মা-কে দিল বড় জোর লাখ তিনেক টাকা। এটা একটা রমরমা ব্যবসা হয়ে দঁাড়িয়েছে। সারোগেসির এই বাণিজ্যকরণ বন্ধ করার জন্য অনেকদিন ধরেই ভাবনা-চিন্তা চলছিল। মেডিকেল সারোগেসি এবং বাণিজ্যিক সারোগেসির মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার কথাই সংসদে আমার বক্তব্যে ছিল।’ তৃণমূল কংগ্রেসের এই রাজনীতিবিদ আরও বলেন, ‘সংসদে আমার বক্তব্যে একটা নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করার কথা তুলি। সেটা হলো ফ্যাশন সারোগেসি। অনেক মহিলা নিজের দেহ সৌন্দযর্ ধরে রাখতে ফ্যাশন সারোগেসির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। যেমন ফিল্ম স্টার, খুব সুন্দরী মহিলা নিজের ফিগার টিকিয়ে রাখতে এটা করে থাকেন। এটাকেও বন্ধ করা উচিত।’ কাকলী ঘোষ দস্তিদার জানান, ‘সাংসদ হিসেবে আরও একটা বিষয় তুলে ধরি. যেমন, ধরুন, ১৯৫৬ সালে টেস্ট টিউব বেবির কোনো ধারণাই ছিল না। অনেক গবেষণায় মেডিকেল সায়েন্সের উন্নতি হয়েছে। সারোগেসিতে ভ্রæণ প্রতিস্থাপন করতে গেলে আগে তো টেস্ট টিউব বেবি তৈরি করতে হবে। সেজন্য টেস্ট টিউব বেবির নিয়ম-কানুন থাকা দরকার। সরকার সেটা করেনি। ফলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জেতার মতো অবস্থা, তাই না?’ নিকট আত্মীয় কারা হবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূল সংসদ সদস্য বলেন, ‘সেটা নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে। কাদের নিকট আত্মীয়, কাদের দূর সম্পকের্র আত্মীয় বলে গণ্য করা হবে, সেটা নিধার্রনের জন্য একটি ধারা এই বিলে যুক্ত হওয়া উচিত ছিল। কারোর যদি নিকট আত্মীয় যেমন, মা, দিদি, বৌদি, জা, ননদ না থাকে, তাহলে সেই জায়গাটা পূরণ করবে কে? তারও সংস্থান রাখার কথা বলেছি আমি। পাশাপাশি আরও একটা কথাও আমি বলেছি- যিনি সারোগেট করছেন তার মেডিকেল ব্যয় ছাড়াও তিনি যদি চাকরিরতা হন বা অন্য কোনো পেশায় থাকেন, তাহলে সন্তানের জন্মদানের পরও যে মাস তিনেক তার বিশ্রামে থাকার কথা, সেই সময়ের আথির্ক ক্ষতিপূরণের ধারাও বিলে থাকা উচিত ছিল। রূপান্তরকামী, ডিভোসির্ বা বিধবারাও বাচ্চা চাইতেই পারেন। সেটাও বিলে রাখার কথা বলেছিলাম, কিন্তু রাখা হয়নি। বিলে এই ধরনের আরও অনেক কিছু থাকা দরকার ছিল, কিন্তু তা হয়নি। আরও নিখুঁত করার সুযোগ ছিল। সরকার চাইলে এখনো ত্রæটিগুলো সংশোধন করতে পারেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডা বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই বিলকে স্বাগত জানিয়েছে। সারোগেসি আইন লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে, বিলে তার উল্লেখ আছে। মহিলাদের সুরক্ষার পাশাপাশি সারোগেট বাচ্চাদের অধিকারও সুরক্ষিত থাকছে এই বিলে। বিলটি আইনে পরিণত হলে জাতীয় সারোগেসি বোডর্ এবং রাজ্য স্তরে রাজ্য সারোগেসি বোডর্ গঠন করা হবে।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভারতে গভর্ ভাড়া দেয়া একটি লাভজনক ব্যবসা। দেশ-বিদেশের সন্তানহীন দম্পতিদের ক্রমবধর্মান চাহিদার কারণে ভারতে গভর্ ভাড়া দেয়ার ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। ভারতে গভর্ ভাড়া সহজলভ্য ও খরচ কম হওয়ায় গভর্ ভাড়া বা সারোগেসি বাণিজ্যের বাজার দঁাড়িয়েছে ১৫০০ কোটি টাকার মতো। প্রায় ৪০ বছর আগে ভারতে কৃত্রিম গভার্ধান বা ইন-ভিট্রো ফাটির্লাইজেশনের (আইভিএফ) যাত্রা শুরু হয়। আর এখন ভারতে প্রায় ২০ হাজার আইভিএফ ক্লিনিক আছে, যার বেশির ভাগই অবশ্য অনুমোদিত নয়। এ ধরনের ক্লিনিক সব থেকে বেশি আছে দিল্লি, মুম্বাই ও চÐীগড়ে। ওদিকে ভারতে সন্তানহীন দম্পতির সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ১৬ কোটি। অথের্র প্রলোভন দেখিয়ে গরিব ও অশিক্ষিত পরিবারের মহিলাদের গভর্ ভাড়া দিতে এজেন্টরা রাজি করায় এবং সেই সুযোগটা নিয়ে থাকে বিদেশি সন্তানহীন দম্পতিরা। উন্নত দেশগুলোতে গভর্ ভাড়া দেয়ার নিয়মবিধি খুব কড়া। আর দিলেও পয়সা দেয়া-নেয়া নিষিদ্ধ। তবে গভর্ ভাড়া নেয়ার আগে ওই মহিলার বয়স ৪৩ বছরের নিচে কিনা, সেটা দেখে নেয়া হয়। দেখে নেয়া হয় তার শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য। এ ছাড়া আগে তিনি অন্তত একটি সন্তানের মা হয়েছেন কিনা এবং গভর্ধারণ ও সন্তান জন্মের সময় কোনো সমস্যা হয়েছিল কিনা সেটাও যাচাই করা হয়। ইন্টারনেট অবলম্বনে