ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অস্বচ্ছতার কারণে সেবাপ্রার্থীদের বিড়ম্বনা

এক সময়ে এই পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিল। দাস মানুষের শরীরের ওপর তাদের কোনো অধিকার ছিল না। তাদের শরীরের ওপর দখলদারিত্ব থাকত দাস মালিকদের। সেই মালিকরা দাসের শরীরকে তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করত। তাদের শ্রম শোষণ করত, তাদের বিক্রি করে দিত। এমনকি তাদের বিকৃত আনন্দের জন্য কখনো কখনো দাসদের বাঘের খাঁচায়ও ছেড়ে দিত। আমাদের অনেক বাবা-মাও তাদের মেয়েশিশুদের বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দেয়। তবে তা অবশ্য বিকৃত আনন্দলাভের জন্য নয়।

প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

সরকার দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারে। ঘর বাড়ি, দালান কোঠা, অফিস আদালত, শিল্পকারখানা, বিদু্যৎকেন্দ্র, রেলপথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশ পথ তৈরিতে বা বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জমি অধিগ্রহণ করে থাকে। তবে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন-২০১৭ ধারা (১৩) অনুসারে ধর্মীয় উপাসনালয়, কবরস্থান ও শ্মশান অধিগ্রহণ করা যাবে না। জমি মালিকদের বিপত্তি হচ্ছে সরকার যে কোনো সময় প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে ৪ ধারার নোটিশ জারি করতে পারেন। নোটিশ প্রাপ্তির পর বিপাকে পড়েন ভূমি মালিকরা। সময় থাকে মাত্র পনেরো (১৫) কার্য দিবস। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে ভূম মালিক আপত্তি দাখিল করতে পারবেন। আপত্তি পাওয়ার পর সম্পত্তির পরিমাণ অনুযায়ী নথি ভূমি মন্ত্রণালয় কিংবা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে সিদ্ধান্তের জন্য প্রেরণ করবেন। এদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্ত জনস্বার্থে গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এর বিরুদ্ধে কোথাও আপিল করা যাবে না। সবশেষে দেখা যাচ্ছে যে, শেষবারের মতো ৭ ধারায় নোটিশ জারি করা হয়। ৭ ধারায় নোটিশ জারির পর আর কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। এখন জানার বিষয় হচ্ছে জমির মূল্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে কীভাবে আদায় করবেন। নোটিশ জারির সময় সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির বাজার মূল্য নির্ধারণের সময় ওই স্থাবর সম্পত্তির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণির ১২ (বার) মাসের গড় মূল্য হিসাব করা হবে। তবে যে বিষয়গুলি সরকার পক্ষ থেকে বিবেচনা করা হয় সেগুলো হচ্ছে: ১। জমির ওপর দন্ডায়মান যে কোনো ফসল বা বৃক্ষের জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষতি; ২। অধিগ্রহণের কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিদ্যমান অপর স্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রস্তাবিত স্থাবর সম্পত্তি বিভাজনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি; ৩। অধিগ্রহণের কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপার্জনের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি; ৪। অধিগ্রহণের কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার আবাসস্থল বা ব্যবসা কেন্দ্র স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হলে উক্তরূপ স্থানান্তরের জন্য যুক্তিসংগত খরচাদি; ৫। সরকারি কোনো প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বাজারদরের ওপর অতিরিক্ত শতকরা ২০০ (দুইশত) ভাগ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। (অর্থাৎ সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি হলে আপনাকে আরো ৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে); ৬। বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ওই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে বাজারদরের উপর অতিরিক্ত শতকরা ৩০০ (তিনশত) ভাগ; ৭। অন্যান্য কারণে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য ওই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে বাজারদরের ওপর অতিরিক্ত শতকরা ১০০ (একশত) ভাগ; ৮। উলিস্নখিত ক্ষতিপূরণ প্রদান ব্যতীত, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, অধিগ্রহণের কারণে বাস্তচু্যত পরিবারকে পূণর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্গাদারের আবাদ করা ফসলসহ কোনো স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হলে ফসলের জন্য জেলা প্রশাসক যেমন ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করবেন, একই রকম ক্ষতিপূরণ বর্গাদারকে দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ মঞ্জুরির প্রাক্কলিত অর্থ জমা দেওয়ার ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা প্রশাসক ক্ষতিপূরণের অর্থ বুঝিয়ে দেবেন। কোনো ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের অর্থ নিতে অসম্মত হলে বা ক্ষতিপূরণ নেওয়ার দাবিদার পাওয়া না গেলে অথবা ক্ষতিপূরণ দাবিদারের মালিকানা নিয়ে কোনো আপত্তি দেখা দিলে ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকারি কোষাগারে রাখা হবে। অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণ পরিশোধ হওয়ার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে গেজেট জারির মাধ্যমে অধিগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হবে। এখন জানার বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে মামলা করা যাবে কিনা? অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা কোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন ধরণের মামলা বা আবেদন গ্রহণ করার এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন-২০১৭ এর (৪৭) ধারায় অধিগ্রহণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা না করার বিষয় উলেস্নখ রয়েছে। এরপরও ৮ ধারায় নোটিশ জারির পরেও অসাধু চক্রের যোগসাজশে অনেকে টাইটেল সু্যট দায়ের করছে। এতে করে ভূমির মালিকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছে। আমাদের সংবিধানের ৪২(২) অনুচ্ছেদের ক্ষতিপূরণসহ বাধ্যতামূলকভাবে স্থাবর সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা না করার বিষয়ে বলা হয়েছে। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ সম্পর্কিত ভূমি নিয়ে কোনো প্রকার মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা নিয়ে পরিপত্র জারি করেছে। বর্তমানে কার্যকর ভূমি আইনটি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির মালিকদের মনে একটু স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেও ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অনিয়ম-দুর্নীতি এবং আইনগত বেশ ফাঁক-ফোকরের ফলে জমির মালিকরা সঠিক উপায়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারছেন না। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় স্বচ্ছতা দরকার। লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স