প্রচলিত আইনে ধষর্ণ মামলা প্রমাণে সমস্যা

আমাদের দেশের আইনানুযায়ী ধষর্ণ একটি ফৌজদারি অপরাধ। যেখানে নারীদের বহুমাত্রিক সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে এবং অপরাধীর কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষ্য-সাবুত সহযোগে ধষর্ণ মামলা প্রমাণের নানা জটিলতা ও সমস্যা নিয়ে লিখেছেন মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
সাধারণত একটি ধষের্ণর মামলায় ধষির্তাই একমাত্র সাক্ষী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি তার চরিত্র নিয়ে কোনো ইঙ্গিত করেন, তাতে তার একান্ত সাক্ষ্য সহজেই দুবর্ল হয়ে যেতে পারে। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ‘চরিত্র বিশ্লেষণ’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি ধষর্ণ মামলার বাদী যদি সাধারণভাবেই একজন অনৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী হন, তাহলে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধষর্ণকারীর বা হরণকারীর পক্ষে আদালতে ব্যবহার করা যাবে অথার্ৎ ওই বিধানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বিচারকাজে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে। এই আইনি বিধানের সুযোগ নিয়ে বিচারে প্রায়ই ভিকটিমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে আদালতে। সেই সুযোগ আসামির পক্ষের কেঁৗসুলিরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী ভিকটিমের অতীত যৌন অভিজ্ঞতা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এজলাসে অভিযোগকারী নারীকে যখন নিজের ধষির্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা বণর্না করতে হয়, তখন চারপাশে উৎসুক চোখের চাহনি আর মুচকি হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রƒপ দেখা যায়। ভিকটিমকে ‘দুশ্চরিত্র’ প্রমাণ করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছে মমের্ আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। অবশ্যই একজন ধষির্তার ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে এসব আইন কঠিনভাবে বাধা হয়ে দঁাড়ায়। দুশ্চরিত্র বা ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ ধারণাটি আইনে আছে বলেই আদালত ধষের্ণর মামলাকারিণীর চরিত্র এবং তার আগের যৌন সম্পকের্র ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেন। ভিকটিমের অতীত যৌন ইতিহাস নিয়ে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি চালু থাকার কারণে বেশির ভাগ নারী ধষর্ণমামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। অনেকেই মামলা মাঝপথে বন্ধই করে দেন। অনেক সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীর জেরায় ভিকটিম নারী মানসিক, সামাজিক ও শারীরিকভাবে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন। যার কারণে ধষের্ণর অভিযোগ বিচারের বাইরে থেকে যায়। আশ্চযের্র বিষয় হলো আইনি ভাষায় ব্যবহৃত ‘দুশ্চরিত্র’ শব্দের কোনো সুনিদির্ষ্ট সংজ্ঞায়ন আইনেই নেই। আইনে সুনিদির্ষ্ট নেই যে একজন নারী কী কী করলে তাকে দুশ্চরিত্রা বলা যায়। ভারতে ২০০০ সালে বিচারপতি বিপি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের সুপারিশক্রমে ভারত সরকার ২০০৩ সালে এই ধারা বাতিল করেছে। বতর্মান প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা আমাদের দেশেও সম্পূণর্ বাতিল করার দাবি তুলেছেন অনেকেই। এসব কারণেই কথিত আছে যে বতর্মান বিচারব্যবস্থায় ধষের্ণর বিচার চাইতে গিয়ে ধষির্তাকে দ্বিতীয়বার ধষর্ণ হতে হয়। ধষর্ণ মামলায় নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কারণ ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে তদন্ত কমর্কাÐে এবং বিচার চলাকালীন সাক্ষী জবানবন্দি ও জেরায় নানা উপায়ে একজন ধষির্তাকে বারবার প্রমাণ করতে হয় সে ধষির্ত। তবে সাক্ষ্য আইনের ধারা ১৫১ ও ১৫২ যে কোনো মামলায় অভিযোগকারী সাক্ষীকে অশোভন, লজ্জাজনক, আক্রমণাত্মক ও বিরক্তিকর প্রশ্ন করা থেকে সাধারণ সুরক্ষা দিয়েছে। ভয় বা লজ্জামুক্ত সাক্ষ্যের জন্য নিদির্ষ্ট কোনো মামলায় আদালত/ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে (ঃৎরধষ রহ পধসবৎধ) বিচার কাযর্ক্রম চালাতে পারেন। এতে ভুক্তভোগী বা সাক্ষী বিরূপ কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন, যা জনাকীণর্ উন্মুক্ত আদালতে তার পক্ষে দেয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। দেশের আদালতগুলোতে নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইনে অনিদির্ষ্টকাল বিচার চলছে। এমনও অনেক নজির আছে যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। যদিও ১৮০ দিনের নিধাির্রত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার আইনি বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন মেনে কাজ করতে পারছেন না নারী ও শিশু নিযার্তন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, সংশ্লিষ্ট কমর্কতার্ ও আইনজীবীরা। এতে আসামিরা যেমন সীমাহীন কষ্টে ভুগছেন, তেমনি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অভিযোগকারিণী। দীঘির্দনেও মামলার সুরাহা না হওয়ায় দুই পক্ষেরই আথির্ক ক্ষতি হচ্ছে আদালতে বিচার চালাতে গিয়ে। নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইনে নিধাির্রত ১৮০ দিন সময়ের মধ্যে মামলা শেষ না হলে কী করতে হবে, বিধানে তা বলা নেই। তবে আইনে আছে, কোনো মামলা নিধাির্রত সময়ে শেষ না হলে সেটা ফৌজদারি কাযির্বধিতে বিচার হবে। কিন্তু ফৌজদারি মামলায়ও কোনো সময়সীমা উল্লেখ নেই। আইনের এসব ফঁাকফোকরে পড়েই উভয়পক্ষ বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা-১৪ অনুযায়ী ধষের্ণর সংবাদ প্রকাশে রয়েছে বিধিনিষেধ তথা বিশেষ নিদের্শনা। যা ভিকটিমের পারিবারিক সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্মানে সুরক্ষা দেয়। একটি ধষের্ণর ঘটনা ঘটার পর বিভিন্ন গণমাধ্যম ধষের্ণর সংবাদ এমনভাবে খবরটা প্রকাশ বা প্রচার করছে, তাতে বিষয়টিতে অন্যদের আরও বেশি করে সুড়সুড়ি দেয়ার মতো। এ প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। আইনে বলা হয়েছে কোনো নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা সে সম্পকির্ত আইনগত কাযর্ধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্য তথ্য কোনো সংবাদপত্রে বা অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাবে যাতে ওই নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়। এবং এই বিধান লঙ্ঘনকারী দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের প্রত্যেকে অনধিক দুই বছর কারাদÐে বা অনূধ্বর্ এক লাখ টাকা অথর্দÐ বা উভয়দÐে দÐিত হবেন। কিন্তু খবর কীভাবে পরিবেশন করবে সে সম্পকের্ বলা হয়নি। যার কারণে বাস্তবে এই আইন মানা হচ্ছে না মিডিয়াগুলোতে। সবার দায়িত্বশীল ভ‚মিকা ও আন্তরিকতা এবং আইনের নিরবচ্ছিন্ন দ্রæত ও সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং ব্যবহার ধষর্ণ প্রতিরোধে সামাজিক সুরক্ষা বহুলাংশে নিশ্চিত করবে। লেখক : আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোটর্ ইমেইল ষষ.নৎধরযধহ@মধসরষ.পড়স