সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগে আইনগত অগ্রগতি কতটুকু?

ব্যাংকে হিসাব খোলার ফরম, বিদু্যৎ বিল, ওয়াসার পানির বিল ইত্যাদি ইংরেজিতে তৈরি হয়। এখন আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে প্রয়াস চালানো। মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে তেমন ভাবে নিজেদের প্রস্তুত করা। বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালত থেকে ২০০৪ সালে নির্দেশনা পাওয়া গিয়েছিল। ইংরেজিতে থাকা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলা লেখার ব্যাপারে বলা হয়।

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
আমাদের দেশে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। আইন করার পরে যে সর্বস্তরে পুরোপুরি বাংলার প্রচলন হয়েছে সেটা বলতে পারি না। উচ্চ আদালতে এবং ব্যাংকে পুরোপুরি চালু হয়নি। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জটিলতা থেকে গেছে। আবার আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্য পুস্তক খুললে ভুল বানান আর ভুল বাক্য দেখা যায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষকেরই নেই প্রমিত বাংলা উচ্চারণ দক্ষতা। শিক্ষকরা যখন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন তারাও তখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। কথা হচ্ছে যে ভাষার আঞ্চলিক রূপ আছে, প্রমিত রূপও আছে। আবার ব্যাংক ও বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হয় বেশি। ব্যাংকে হিসাব খোলার ফরম, বিদু্যৎ বিল, ওয়াসার পানির বিল ইত্যাদি ইংরেজিতে তৈরি হয়। এখন আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে প্রয়াস চালানো। মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে তেমন ভাবে নিজেদের প্রস্তুত করা। বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালত থেকে ২০০৪ সালে নির্দেশনা পাওয়া গিয়েছিল। ইংরেজিতে থাকা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলা লেখার ব্যাপারে বলা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়; বাংলাকে সরিয়ে ইংরেজিতে লিখা হয় সাইনবোর্ড, বিশেষ করে শহরের অভিজাত অঞ্চলগুলোতে। আর বাংলায় লিখলেও অনেকগুলোতে দেখা যায় ভুলের ছড়াছড়ি। জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষা জ্ঞান থাকতে হবে। পড়াশুনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে, ভাষার চর্চাও যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রত্যেক মানুষের কাছে মাতৃভাষা সর্বাধিক প্রিয়। মায়ের প্রতি যেমন আন্তরিক শ্রদ্ধা, মাতৃভাষার প্রতিও গভীর অনুরাগ-শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকে। মায়ের কাছ থেকে প্রথম এ ভাষা শিখা শুরু। তাই জগতে পদার্পণ করার পর থেকে মাতৃভাষার সঙ্গে আমাদের আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। মায়ের বুলি দ্বারাই আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মায়া-মমতা ইত্যাদি মনের ভাব প্রকাশ করি। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আলস্নাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহ বলেছেন, 'মানুষের স্বভাবের মধ্যে যদি ভাষার বীজ না থাকত, তাহলে ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যেত না। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সঙ্গে তার মধ্যে ভাষার বীজ রেখে দিয়েছেন। এদিক থেকে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান বলা যেতে পারে।' মাতৃভাষার সঙ্গে শিশুমনের একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে; সেই সম্পর্ক পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে লালিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই মাতৃভাষার সাহায্যে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে, তা হয়ে ওঠে সহজ ও অন্তরঙ্গ। যথার্থ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে বাল্যশিক্ষার সঙ্গে মাতৃভাষার এতখানি নিবিড় যোগ থাকার ফলে শিক্ষার আলো মনের দৃষ্টি উন্মুক্ত করে দেয়। জীবনকে ব্যবহারিক জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য লাভ করতে সহায়তা করে। মাতৃভাষার মাধ্যমে যাবতীয় বিষয়ের শিক্ষাদান আমাদের অতি প্রয়োজনীয় কর্তব্য। এই কর্তব্য কেবল শিক্ষার সম্পূর্ণতার জন্য, শিক্ষার সার্বজনীনতার জন্য নয়- মাতৃভূমির, মাতৃভাষার মর্যাদা ও গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্যও। এ বিষয়ে এখনো যতটুকু অসম্পূর্ণতা আছে, তা বিদূরিত করতে হবে। পরিশেষে বলব, আমরা আমাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বিশ্বের অন্য ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাব। অন্য ভাষা শিখতে হবে কিন্তু সেটা আমাদের বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে নয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে তা বের করে পরিকল্পনা অনুসারে সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রের একটা ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা থাকা দরকার। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলা শিক্ষক পদায়ন করা দরকার। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, শিশু শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা শব্দের উচ্চারণ ও বানান শিখে। অফিস-আদালত, ব্যবসায়বাণিজ্য ও উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযথভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। তবেই বাংলা ভাষা ও ভাষা দিবসের যথাযথ মূল্যায়ন হবে। লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট