বিজ্ঞাপনে প্রতারণামূলক দাবি ও আইন

দেশের অনেক নামকরা খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন এবং লেবেলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে। কোন নিদির্ষ্ট প্রসাধনী ব্যবহার করলে নিদির্ষ্ট সময়ের মধ্যে ফসার্ হওয়া যাবে কিংবা কোন নিদির্ষ্ট খাবার খেলে বাচ্চারা অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠবেÑ এ ধরনের বিজ্ঞাপনের প্রচার প্রায়ই চোখে পড়ে।

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

আবরার মাসুদ
চটকদার বিজ্ঞাপনের প্রতারণায় পড়ে ব্যাপকভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন ভোক্তাসাধারণ। যেমন : রং ফসার্কারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে বলা হয়ে থাকে, ‘বিভিন্ন দেশের সব ক্রিমকে হারিয়ে এলো অমুক ক্রিম।’ এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন করাই যেতে পারে যে, তারা কোন কোন ক্রিমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এমনটি বলছে? কীসের ভিত্তিতে তারা এসব বলছে? আবার বাচ্চাদের কোনো কোনো খাবারের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে ‘আরও শক্তিশালী, লম্বা ও তীক্ষè করে তুলবে এই খাদ্য’। বিজ্ঞাপনে এ ধরনের বিবৃতি কীসের ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে সেটা একটি যৌক্তিক প্রশ্ন। কেউ কেউ বিজ্ঞাপনে বলছে, তাদের পণ্যটি অন্যদের চেয়ে বেশি খঁাটি। কিন্তু এ ধরনের কথার ভিত্তি নেই। মূলত এর মাধ্যমে তারা ভোক্তা সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। কিছুদিন আগেই একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের শরবতের উপাদানসংক্রান্ত বিভ্রান্তির কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাদের চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন করছে ‘পৃথিবীর সেরা হালাল পানীয়’ বলে। কিন্তু এই সনদ তাদের কে দিয়েছে? আবার ‘একশোর ওপরে অসুখ ভালো হয়’ এ ধরনের তথ্য দিয়েও বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে আমাদের দেশে। ‘আমার পণ্যই সেরা’ এমন বক্তব্যও আইন ও বিধিমালাকে তোয়াক্কা করে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের দাবি অবৈধ, কেননা তাতে অন্যের পণ্যকে খাটো করা হচ্ছে। দেশে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে নিজ পণ্যের গুণকীতের্ন যাচ্ছেতাই বলা হচ্ছে এবং অন্যের পণ্যকে খাটো করা হচ্ছে। সম্প্রতি এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে নিরাপদ খাদ্য কতৃর্পক্ষ। যারা নিজেদের পণ্যে গুণ বণর্না করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, তারা কীসের ভিত্তিতে এমনটি বলছেন তা জানতে চেয়েছে এই কতৃর্পক্ষ। একই সঙ্গে এ ধরনের বিজ্ঞাপন যে আইনবিরুদ্ধ, সেটিও পত্র-পত্রিকা মারফত বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে কতৃর্পক্ষের তরফে। শাস্তিযোগ্য অপরাধ : নিরাপদ খাদ্য কতৃর্পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণ ও খাদ্য ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে প্রচার করা এক গণ-বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কোনো কোনো খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে পণ্যের লেবেলে এমনকি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতেও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে।’ উদাহরণ হিসেবে বলা হয়Ñ ‘উৎপাদিত পণ্যটি সম্পূণর্ ক্যামিকেল মুক্ত, বাজারের সেরা, আমারটাই সেরা, বিশ্বের সেরা ড্রিংকস, একটু বেশি পিওর, খেলে অসম্ভব হবে সম্ভব, রাতারাতি কমে যাবে বয়স, ভেজাল প্রমাণে লাখ টাকা পুরস্কার, ১০০% পিওর, ত্বক হয়ে উঠবে উজ্জ্বল, রোগ থেকে দেয় সুরক্ষা, পণ্যটি যেন অমৃত সুধা, অন্যান্য পণ্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি অভিব্যক্তি দাবি করছেন যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’ এতে আরও বলা হয়, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এর লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর শাস্তি সবোর্চ্চ পঁাচ বছর পযর্ন্ত কারাদÐ বা ২০ লাখ টাকা পযর্ন্ত জরিমানা বা উভয়-দÐ হতে পারে। বিজ্ঞাপনের বিবৃতিগুলো যথাথর্ করার জন্য নিরাপদ খাদ্য কতৃর্পক্ষ ৩১ জুলাই পযর্ন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এর মধ্যে যার যার লেবেলিংয়ে ত্রæটি আছে সে সব পণ্য নতুন করে বাজারে আনতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন ও আইন : পণ্য বা সেবা বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে কোম্পানিগুলো প্রায়ই লোভনীয় সব পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। পানীয় খেলে বাড়ি-গাড়ি পাওয়া যাবে, প্রসাধনী কিনলে সোনার লকেট, হীরার নেকলেস পাওয়া যাবে প্রভৃতি বিজ্ঞাপন অহরহই চোখে পড়ে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের কারণে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির কদর বাড়ে। কোম্পানিগুলো শেষতক লোভনীয় পুরস্কারগুলো কতটা দেয়, তা নিয়ে বিতকর্ আছে। উত্তরানিবাসী মোবাশ্বির লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, তিনি যখন বাড়ি বানান তখন একটি সিমেন্ট কোম্পানি লোভনীয় পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল। অফারে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক ক্রেতাই কোনো না কোনো পুরস্কার জিতবেন। সে অফারের সবোর্চ্চ পুরস্কার ছিল ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট আর সবির্নম্ন পুরস্কার ছিল ৫০ টাকা ডিসকাউন্ট। মোবাশ্বির জানান, তিনি যতবারই সিমেন্ট কিনেছেন প্রতিবারই সবির্নম্ন পুরস্কারটি পেয়েছেন এবং অনেক খেঁাজ নিয়েও এমন কোনো ক্রেতার সন্ধান পাননি যিনি ঢাকার ফ্ল্যাট জিতেছেন। এভাবেই লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফঁাদে ফেলে সরলমনা ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করে ব্যবসায়িক স্বাথর্ হাসিল করছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। অনেক ক্ষেত্রে লোভনীয় পুরস্কারগুলো কেবল কাগজে-কলমে থাকে এবং কখনই কোনো ক্রেতা পুরস্কার জিততে পারেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কারের তালিকায় বাড়ি-গাড়ির মতো আকষর্ণীয় কিছু থাকলেও বাস্তবে সেগুলো কেউ জিততে পারেন না। বরং পুরস্কারের তালিকায় থাকা সবচেয়ে কম দামের পুরস্কারটি জেতেন। বাংলাদেশের আইনে বাণিজ্যিক কোনো পণ্যের প্রসারে কোনোরকম লোভনীয় পুরস্কারের ঘোষণা দেয়াই বাংলাদেশের আইনে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। ১৮৬২ সালের দÐবিধিতে ১৯৬৫ সালে সংযুক্ত ২৯৪খ ধারায় এ বিধান বলা হয়েছে। কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে টাকা বা অন্য কোনো দ্রব্যের প্রলোভন দেখানোকে সম্পূণর্ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এ ধারায়। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে ‘উৎসাহ দিতে’ বা পণ্য কিনতে ‘উদ্বুদ্ধ’ করতে, কোনো পণ্য ‘জনপ্রিয়’ করতে কুপন, টিকিট, সংখ্যা বা অন্য যে কোনো কিছুর বিপরীতে ‘যে নামেই হোক’ টাকা বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের বিজ্ঞাপনদাতাদের ছয় মাসের কারাদÐ বা জরিমানা অথবা উভয় দÐের সুযোগ দেয়া হয়েছে এ ধারায়। দÐবিধির ২৯৪খ ধারায় প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের দায়ে শুধু যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি অপরাধী হবে, তাই নয় বরং যে মিডিয়া এটি প্রকাশ করবে, তাকেও সাজার মুখোমুখি করা হবে বলে বিধান দেয়া হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রকাশে মিডিয়াকেও সতকর্ হওয়া প্রয়োজন। পণ্যের প্রসারে প্রলোভনমূলক পুরস্কার প্রদান করা বেআইনি হওয়ায় কোনো ভোক্তা যদি এ ধরনের পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন আর পরে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি তাকে সে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করে বা প্রতারণা করে, সে ক্ষেত্রে ওই পুরস্কার আদায়ের জন্য তিনি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবেন না। কারণ যে পুরস্কারটিকে আইন ‘বেআইনি’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, তা আইন কীভাবে আদায় করে দেবে?