নারী নির্যাতন মামলায় ক্যামেরা ট্রায়াল

প্রকাশ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

আদনান ওয়াসিম
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতের যেমন আবশ্যকতা রয়েছে, তেমনি বিচার প্রক্রিয়াও প্রকাশ্যে হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অর্থাৎ নিরপেক্ষ আদালতে প্রকাশ্যে বিচারলাভ অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার। আর এ অধিকারকে আমাদের সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে মৌলিক অধিকার হিসেবে। সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইবু্যনালে দ্রম্নত ও প্রকাশ্যে বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।' আইনের ভাষায় এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়াকে 'পাবলিক ট্রায়াল' বলা হয়। এ ছাড়া 'ক্যামেরা ট্রায়াল' নামে আরও এক ধরনের বিচার প্রক্রিয়া চালু আছে। পুরো বিচার প্রক্রিয়া প্রকাশ্য আদালত বা ট্রাইবু্যনালে শেষ করাই হলো পাবলিক ট্রায়াল। অন্যদিকে একজন বিচারক যখন তার নিজস্ব কক্ষে অথবা রুদ্ধদ্বার এজলাসে সাক্ষ্য ও জবানবন্দি এবং জেরা গ্রহণ করেন, সেটাই ক্যামেরা ট্রায়াল। অর্থাৎ সে সময় বিচার করে শুধু দুই পক্ষের আইনজীবী, আসামি, ভিকটিম উপস্থিত থাকেন। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সংবিধানে যেহেতু পাবলিক ট্রায়ালকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেহেতু ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচার করলে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তর হবে 'না'। কেননা সংবিধানের ৩৫(৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোনো দন্ড বা বিচারপদ্ধতি সম্পর্কিত কোনো বিধানের প্রয়োগে এই অনুচ্ছেদের (৩) বা (৫) দফার কোনো কিছুই প্রভাবিত করিবে না। তার মানে কোনো আইনে যদি ক্যামেরা ট্রায়ালের কথা উলেস্নখ থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হবে না। আপাতঃদৃষ্টিতে ক্যামেরা ট্রায়ালকে ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে না হলেও, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। যেমন- ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমের জবানবন্দি গ্রহণের সময়। একজন ধর্ষিতা নারীর জন্য উন্মুক্ত আদালতে জনসম্মুখে ধর্ষণের জবানবন্দি দেয়া রীতিমতো অস্বস্তিকর এবং ওই নারীর জন্য নিঃসন্দেহে অপমানজনক। এ ছাড়া বিপক্ষ আইনজীবীর নানা ধরনের জেরা ভিকটিমকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। আর ধর্ষণের বিবরণ শুনতে উৎসুক জনতাও আদালতে ভিড় জমায়। এমন পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই এ ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়াল হলে ভিকটিমের পক্ষে জবানবন্দি দেয়া সহজ হয়। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এই দিকটিতে লক্ষ্য রেখেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়ালে বিচার করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনটির ২০(৬) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে কিংবা ট্রাইবু্যনাল স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করিলে এই আইনের ধারা ৯-এর অধীন অপরাধের বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠান করিতে পারিবে।' নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০(৬) ধারা নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। তবে বাস্তবতা এখনো পুরোপুরি অনুকূলে নয়। অনেকে এখনো ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়ালের আবশ্যকতা স্বীকার করে না। কিন্তু ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এমন ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্রায়ালে বিচার করা উচিত। ধর্ষিতা নারীকে সবার সামনে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা তাকে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করার শামিল। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আইনের বিধানের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রয়োজন সচেতনতা এবং সহযোগিতা।