মুসলিম আইনে বিবাহ ও দেনমোহর

প্রাসঙ্গিক আইনি আলোচনা

বিবাহ মানবসভ্যতার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে যে খেতাব লাভ করেছে তাতেও অবদান বিবাহর। পৃথিবীর আদি থেকে মানব ধারার সুশৃঙ্খল বিন্যাস কেবল বিবাহনামক প্রতিষ্ঠানের জন্যই টিকে আছে। বিবাহ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে মূলত ধর্মীয় প্রভাবে। বাংলাদেশে বিবাহপ্রথাও মূলত গড়ে উঠেছে ধর্মীয় আইনের ওপর ভিত্তি করে। মুসলিম আইনে বিবাহ ও দেনমোহর নিয়ে দুই পর্বের প্রাসঙ্গিক আইনি আলোচনার আজ প্রথম পর্ব। লিখেছেন উদয় তাসমির

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী মানুষ মুসলমান এবং তাদের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা পরিচালনার মানদন্ড কোরআন এবং সুন্নাহ হলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে এ সব বিধানের বাস্তবায়ন এখন কেবল বিবাহ, তালাক ও সম্পত্তি ভাগবণ্টনের মধ্যেই সীমিত। বাংলাদেশের মতো একটি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মুসলিম আইনের অধীনে বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার, দান, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি পরিচালিত হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) বাস্তবায়ন আইন, ১৯৩৭সহ আরও কিছু আইনের অধীনে। যার কারণে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঠিক ধারণা কেবল এর মূল উৎস থেকেই পাওয়া যেতে পারে। পবিত্র কোরআনে সূরা নিসার ২১নং আয়াতে বিবাহকে ঘোষণা করা হয়েছে 'মিশাক্বান গালিযা' হিসেবে। যার অর্থ দাঁড়ায় 'পবিত্রতম চুক্তি'। সাইয়ে্যদ আমীর আলী তার মোহামেডান ল' গ্রন্থে বিবাহকে সংজ্ঞায়ন করেন, 'বিবাহ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে মানুষ অসভ্যতা এবং ব্যভিচারিতা থেকে মুক্ত থাকে'। আব্দুর রহিম তার দ্যা প্রিন্সিপাল অফ মোহামেডান জুরিসপ্রম্নডেন্স গ্রন্থে বিবাহকে উলেস্নখ করেন দুটি মানুষের মধ্যকার একটি ইবাদতের সম্পর্ক হিসেবে। বিচারপতি মাহমুদ তার আ. কাদির ও সালিশি মোকদ্দমার রায়ে বলেছেন, 'মুসলিম বিবাহ কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, একটি বিশুদ্ধ দেওয়ানী চুক্তি যার উদ্দেশ্য পারিবারিক জীবনযাপন ও বৈধ সন্তান দান।' গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে মুসলিম আইনে বিবাহকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো- ১) বৈধ বিবাহ, ২) অনিয়মিত বিবাহ, ৩) অবৈধ বিবাহ। মুসলিম আইনের অধীনে একটি বৈধ বিবাহের শর্তাবলি- বিবাহ করতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয়ের মধ্যে একপক্ষকে স্বাধীন প্রস্তাব দিতে হবে এবং অন্য পক্ষ থেকে স্বাধীনভাবে তা গ্রহণ করতে হবে। দেনমোহর নির্ধারণ করতে হবে। প্রস্তাব দান ও গ্রহণ একই বৈঠক/মজলিসে কমপক্ষে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ সাক্ষী কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা সাক্ষীর সামনে হতে হবে। এটিই বিবাহবন্ধন সংগঠিত হওয়ার মূল শর্ত। তবে ১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী, উপরোলিস্নখিত শর্তাবলি ছাড়াও মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুসারে সরকার নিযুক্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার দ্বারা অবশ্যই বিবাহ রেজিস্ট্রি করাতে হবে। রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। বিবাহ রেজিস্ট্রি করা হলে বর ও কনে উভয়ই নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ বা দাবি আদায় করতে পারেন- ১) বিবাহের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করলে যে সনদ পাওয়া যায় সেটি হলো একটি বৈধ বিবাহের দলিল বা কাবিননামা; ২) রেজিস্ট্রেশনের ফলে বিবাহের সব তথ্য সরকারের তথ্য ভান্ডারে নথিভুক্ত হয় বলে বর বা কনেপক্ষ ওই বিবাহের সত্যতা অস্বীকার করতে পাওে না এবং একে অন্যের প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক দায়-দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়; ৩) কাবিননামা থাকলে বিবাহে দুই পক্ষই বিশেষ করে নারীরা আইনে প্রদত্ত সব সুরক্ষাসহ, তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে; ৪) স্ত্রী স্বামীর প্রতারণার স্বীকার হলে এই রেজিস্ট্রেশন বা কাবিননামা এর সনদই রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে; ৫) স্বামীর মৃতু্য পরবর্তীকালে স্বামীর সম্পত্তির বৈধ অংশসহ অন্যান্য দাবি আদায়ে এই কাবিননামা দলিলটি আইনগত দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়; ৬) তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় এমনকি স্ত্রী তার প্রাপ্ত দেনমোহর ও ভরণপোষণ অর্থ আদায় বা দাবির লক্ষ্যেও বিবাহের রেজিস্ট্রেশন বা কাবিননামা একটি অত্যাবশ্যকীয় দলিল; ৭) স্বামীর অবর্তমানে সন্তানের বৈধ পরিচয় নিশ্চিত করতে কাবিননামা প্রয়োজন হতে পারে; ৮) বিদেশ গমনের ক্ষেত্রেও কিছু রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ভ্রমণে আগ্রহী কোনো নারী যদি নিজের ব্যক্তিগত তথ্য প্রদানকালে নিজেকে বিবাহিতা পরিচয় দিলে বিবাহের প্রমাণ হিসেবে বিবাহের রেজিস্ট্রেশনের বা কাবিননামার একটি সনদ প্রয়োজন হতে পারে; বিবাহের নিবন্ধনের ব্যর্থতায় শাস্তির বিধান : মুসলিম বিবাহ এবং তালাক নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪ [গঁংষরস গধৎৎরধমবং ধহফ উরাড়ৎপবং (জবমরংঃৎধঃরড়হ) অপঃ, ১৯৭৪] এর ৫(৪) ধারা মোতাবেক প্রতিটি 'বিবাহ সম্পর্কে অবহিত এবং নিবন্ধনকরণ'-এর ব্যাপারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রেজিস্ট্রি ব্যতিরেকে বিবাহ হয়ে গেলে বিবাহের ত্রিশ দিনের মধ্যে বরপক্ষকে উহা নিকাহ রেজিস্ট্রারকে জানাতে হবে, অন্যথায় মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪ অনুসারে দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা তিন হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। লেখক : অ্যাসোসিয়েট বিএন্ডএম লিগ্যাল