মামলায় ধর্ষিতার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম (৫১ ডিএলআর ১২৯) মামলা এবং ১৭ বিএলটি ২৫ এর অন্য একটি মামলায় উলেস্নখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (৫৭ ডিএলআর ৫৯১) উলেস্নখ আছে যে, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে। বাংলাদেশের আদালতে 'চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য' প্রমাণ হিসেবে কতটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কী ছিল তা একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র (১৩ বিএলসি ২০০৮) মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা তার শিশুসহ কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌনসম্পর্কের ইতিহাসকে তার 'চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য' বিবেচনায় তাকে 'যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত' বলে উলেস্নখ করা হয় এবং বলা হয় 'ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।' রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য (২৮ বিএলডি হাইকোর্ট ডিভিশন ২০০৮) মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দু'বার বিয়ে হয়েছিল। তাকে তার নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে 'এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দু'বার বিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উলিস্নখিত কারণে বাদিনীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।' শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের (৩০ বিএলডি এডি ২০১০) মামলায় দেখা যায় যে, আদালত অভিযোগকারিণীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তার 'খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র' হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারিণী ছিলেন একজন অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তার নিয়োগকর্তার হাতে ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযোগকারিণী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপে গাছ বেয়ে উঠে প্রবেশ করেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদিনী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তার দেয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে। ধর্ষণ মামলায় ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে অভিযুক্তের পক্ষ থেকে দেয়া সাক্ষ্য কতটুকু গ্রহণ করা যাবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইন্ডিয়ান ল' কমিশনের ৮৪ তম রিপোর্টে (১৯৮০) বলা হয়েছে, ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি লিগ্যাল সিস্টেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ এবং আইনি-কার্যধারা হতে অনীহা অনুভব করার অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান (২৫ বিএলডি এডি ২০০৫) মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয়া হয় যে, 'বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।' লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা