ধর্ষণ মামলায় ন্যায়-বিচার

প্রয়োজন সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার সংশোধন

প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

উদয় তাসমির অ্যাসোসিয়েট, বি অ্যান্ড এম লিগ্যাল
একজন ধর্ষিতা আদালতে বিচার চাইতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবারও ধর্ষিত হন। এই ধর্ষণের মাধ্যম শারীরিক অঙ্গ নয়, আইন ব্যবস্থা নিজে! এইরূপ ধর্ষণ এখানে বৈধ। ঔপনিবেশিক আমলের ধ্যান-ধারণার যে গুটি কয়েক বিষ আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি তার মধ্যে সাক্ষ্য আইন- ১৮৭২-এর ধারা ১৫৫(৪)টি অন্যতম। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারাটি সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে অভিযোগ এনে সাক্ষীর সাক্ষ্যমান নষ্ট করার জন্য সংযোজন করা হয়েছে। যদিও ওই কাজটি সাক্ষ্য আইনের ধারা- ১৪৫ ও ১৪৬ (জেরাসংক্রান্ত ধারা) এর মাধ্যমে করা যেতে পারে। তবে সত্যকে আরও স্পষ্ট এবং নিখুঁতভাবে উদ্ঘাটন করার জন্য ধারা ১৫৫ একটি সহযোগী বিধান। ধারা ১৫৫-এর উপধারা (৪) হঠাৎ করেই সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা থেকে কেন এবং কীভাবে যেন অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একজন ধর্ষিতার চরিত্রকে কলঙ্কিত করার অভিপ্রায়ে মোড় নিল। ধারা- ১৫৫(৪)-এ বলা হচ্ছে, 'কোনো লোক যখন বলাৎকার কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে সোপর্দ হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রসম্পন্ন রমণী'। এই ধারা এখানে অভিযোগকারিণীর যৌন জীবনকে কলঙ্কিত করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরা। ধর্ষিতার যৌন জীবন হয়ে দাঁড়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় একটি বিষয়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের আইনজীবী আজে-বাজে অপ্রাসঙ্গিক অপমানজনক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন। ধর্ষণের ঘটনাকে ঠেলে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে কৃতকর্মের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। ধারাটির কার্যক্ষেত্র কিন্তু অভিযোগকারিণী ও আসামির মধ্যকার যৌন সম্পর্কের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ক্ষান্ত থাকে না। অর্থাৎ বাদিনীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সীমা বা তাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা শুধু ওই ধর্ষণের মামলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। চলে যায় বাদিনীর অতীত যৌন সম্পর্কগুলোতে। এমনকি বাদিনীর বৈবাহিক সম্পর্ককেও আঘাত করা হয়। উদ্দেশ্য হলো- মামলায় সন্দেহ তৈরি করা। কারণ ফৌজদারি মামলায় শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে নীতি হলো- কোনো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া যার ব্যতিক্রমে অভিযুক্তকে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বেকসুর খালাস করাও সম্ভব হয়। ধর্ষণের মামলাগুলোতে অভিযুক্তের আইনজীবী বারবার প্রমাণের চেষ্টা করেন, আসলে বাদিনী অবৈধ যৌন সম্পর্কে অভ্যস্ত। এটার জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। এখানে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আসামি জোর করেনি বরং বাদিনী বা অভিযোগকারিণী নিজেই আসামিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে এনেছে। এমনকি অভিযোগকারিণীকে পতিতার পর্যায়ে ঠেলে নামাতেও কুণ্ঠিত হয় না। যদিও এই আইনের (সাক্ষ্য আইন), ধারা ১৫১ (অশালীন এবং কুৎসা প্রশ্ন), এবং ধারা ১৫২ (অপমান কিংবা উত্ত্যক্ত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন), মোতাবেক কোনো প্রশ্ন করা হলে আদালত যদি তা অশালীন এবং অপমানজনক মনে করেন তবে সে ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা থেকে আইনজীবীকে বিরত রাখতে পারেন। কিন্তু খোদ একটি আইনের ধারাই যেখানে অভিযোগকারিণীকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই অভিযোগকারিণীকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কতটুকু এবং কীভাবেই বা রক্ষা করতে পারবে? অনাকাঙ্ক্ষিত ধারা ১৫৫(৪)-এর ব্যবহার যদি শুধু আদালত কক্ষে অভিযোগকারিণীকে দুশ্চরিত্রা পর্যন্ত দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকত এবং এর দ্বারা যদি অভিযোগকারিণীর ন্যায়বিচার পাওয়ার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত না হতো তাও এই ঔপনিবেশিক আইনটির উপস্থিতি মেনে নেয়া যেত। কিন্তু বাস্তবচিত্র খানিকটা ভিন্নরকম। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলোতে 'চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য' প্রমাণ হিসেবে কতটুকু ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কি ছিল তা শনাক্ত করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বস্নাস্ট) একটি গবেষণা করেছে। ঢাকা ল' রিপোর্টার্স এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনে ১০ বছরে (২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত) প্রকাশিত সব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈবাহিক অবস্থান থেকে শুরু করে একজন ধর্ষিতার অতীত সম্পর্কের ইতিহাস আসামি দ্বারা নিজকে রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং সে সব বিবৃতি আদালত কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র [১৩ বিএলসি ২০০৮] মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তার শিশুসহ তার কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালানোর সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌন সম্পর্কের ইতিহাসকে তার 'চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য' বিবেচনায় তাকে 'যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত বলে উলেস্নখ করা হয় এবং বলা হয়, 'ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন'। রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য [২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮] মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দু'বার বিয়ে হয়েছিল। তাকে তার নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে, 'এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দু'বার বিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উলিস্নখিত কারণে বাদিনীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।' সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র [৫৭ ডিএলআর (এডি) (২০০৫)] মামলায় আগের সম্পর্কের ইতিহাস টেনে আনা এবং ধর্ষিতার দ্বারা শারীরিক প্রতিরোধ প্রদর্শন করতে না পারার বিষয়ে দেয়া অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আদালত আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন এবং অভিযোগকারিণীকে সম্মানের সঙ্গে এই বলেন যে যদি একজন নারী সহজেই একজন পুরুষের লালসার শিকার হন এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সামান্যতম বাধাও না দেন, যা তার কাছে তার জীবনের থেকেও মূল্যবান, তবে তা ধর্ষণ নয়। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারিণী তারই নিজ বাসায় তার প্রতিবেশী দ্বারা ধর্ষিত হন, যিনি তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে বিয়ে করার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন। শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে আদালত অভিযোগকারিণীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তার 'খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র' হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারিণী ছিলেন একজন অল্প বয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তার চাকরিদাতা দ্বারা ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে 'যেহেতু অভিযোগকারী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে ঢুকেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তার দেয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে'। অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান [২৫ বিএলডি (এডি) (২০০৫)] মামলায় আদালত বলেছিলেন, 'বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে'।