সালিশ আইনে বিরোধ সমাধান

প্রকাশ | ১৪ মে ২০১৯, ০০:০০

মো. মামুনুর রশীদ
বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সিমেন্ট ও টেলিযোগাযোগ খাত বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র এবং এই ক্ষেত্রগুলোতে প্রতিনিয়তই পালস্না দিয়ে বাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগ। তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও ব্যবসায়িক ও আইনগত বিরোধগুলো সহজে ও দ্রম্নততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য বিদ্যমান কাঠামো এখনো বহুল প্রচলিত হয়ে ওঠেনি। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪টি ও অধস্তন আদালতে ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি। মোট মামলার মধ্যে দেওয়ানি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৬১টি, ফৌজদারি ২০ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭ এবং অন্যান্য ৯১ লাখ ৮২২টি। উলিস্নখিত মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর ও তার চেয়ে বেশি সময় ধরে চলমান মামলার সংখ্যা ৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৬। বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান চাইবে না তার বিরোধটি ৫ বছর ধরে নিষ্পত্তি করতে। তবে আদালত প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ার বাইরেও বিরোধগুলো নিরসনের লক্ষ্যে সালিশ আইন ২০০১ প্রণয়ন করা হয়। দেশি-বিদেশি বিরোধগুলো সালিশ আইন ২০০১-এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। সালিশি আইন, ২০০১-এর আওতায় বিবাদমান পক্ষগুলোর বিরোধে সালিশের পরিধি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিষয় পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছে। সালিশি আইনে একদিকে বাংলাদেশের একজন নাগরিক বা সংস্থা এবং অন্যদিকে একজন বিদেশি, বিদেশি অভিবাসী, বিদেশি কোম্পানি, বিদেশিদের নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি বা ফার্ম এবং বিদেশি সরকারের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিষয়ে সালিশের সুযোগ আছে। তেমনি ব্যবস্থা আছে সালিশি রোয়েদাদকে আদালতের ডিক্রি হিসাবে জারি করার। শুধু তাই নয়- দেওয়ানি কার্যবিধির বিধান অনুযায়ী আদালত নির্দেশিত কিছু শর্তসাপেক্ষে বিদেশের সালিশি রোয়েদাদকে আদালতের ডিক্রিরূপে জারি করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এ আইনে। আইনে সালিশি চুক্তি থেকে উদ্ভূত বিরোধ ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিবদমান পক্ষগুলোর নিযুক্ত একক কিংবা একাধিক সালিশকারীকে নিয়ে গঠিত ট্রাইবু্যনালে নিষ্পত্তির ব্যবস্থাই শুধু রাখা হয়নি; উপরন্তু সালিশি চুক্তিতে অনুরূপ সংখ্যক সালিশকারীর উলেস্নখ না থাকলে সে ক্ষেত্রে তিনজন সালিশকারীর সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইবু্যনালে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তিনজন সালিশকারী নিয়ে ট্রাইবু্যনাল গঠনের ব্যাপারে পক্ষগুলো যদি একমত না হয় সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষ একজন সালিশকারী নিয়োগ করবে এবং এভাবে নিযুক্ত সালিশকারীরা মিলে তৃতীয় একজন সালিশকারী নিয়োগ করবে এবং তিনিই হবেন সালিশ ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যান। পক্ষান্তরে বিবদমান পক্ষগুলো যদি এতে রাজি না হয় তাহলে তারা সমসংখ্যক সালিশকারী নিয়োগ করবেন এবং এই সালিশকারীরা সম্মিলিতভাবে অতিরিক্ত একজন সালিশকারী নিয়োগ করবেন যিনি সালিশি ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যপক্ষ থেকে অনুরোধ পাওয়ার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে একক সালিশকারী নিয়োগের ব্যাপারে কিংবা পক্ষগুলোর নিয়োগকৃত সালিশকারীদের কোনো একজনের নিয়োগের ব্যাপারে একপক্ষ যদি একমত হতে না পারে কিংবা যে কোনো পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে সালিশকারীরা তাদের নিযুক্তির দিন থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে যদি তৃতীয় সালিশকারী নিয়োগে একমত হতে না পারে সে ক্ষেত্রে নিয়োগের সম্মত পদ্ধতির অনুপস্থিতিতে দেওয়ানি আদালত এই তৃতীয় সালিশকারীর নিয়োগ দেবেন। তবে ব্যতিক্রম হলো- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশির ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি অথবা প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের অন্য যে কোন বিচারক এরূপ সালিশকারী নিয়োগ করবেন। আইনে আরও বিধান আছে, সালিশি ট্রাইবু্যনালের যে কোনো পক্ষকে যে কোনো অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়ার যোগ্যতা থাকবে এবং এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। বিবদমান পক্ষগুলোর সম্মতিক্রমে সালিশি ট্রাইবু্যনাল সালিশি কার্যক্রমের যে কোনো পর্যায়ে মধ্যস্থতা, আপস বা অন্য কোনো উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন। সালিশি ট্রাইবু্যনালের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নে তার কাছে রিপোর্ট পেশ করার জন্য বিশেষজ্ঞ বা আইন উপদেষ্টা এবং টেকনিক্যাল বিষয়ে তাকে সহায়তাদানের জন্য নিরূপণকারী (অ্যাসেসর) নিয়োগ করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা থাকবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশির ক্ষেত্রে প্রদত্ত রোয়েদাদ বাদে এই আইনের অধীনে প্রদত্ত যে কোনো সালিশি রোয়েদাদের বেলায় সেই রোয়োদাদ প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট যে কোনো পক্ষের আবেদনক্রমে দেওয়ানি আদালত সেই রোয়েদাদ বাতিল করতে পারেন। আর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশির ক্ষেত্রে প্রদত্ত রোয়েদাদের বেলায় সেই রোয়েদাদ বাতিল করতে পারেন হাইকোর্ট বিভাগ। রোয়েদাদ বাতিল করার বা বাতিল করতে অস্বীকৃতি জানানোর কিংবা বিদেশি সালিশি রোয়েদাদ কার্যকর করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে দেওয়ানি আদালতের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করা যেতে পারে। উপরোক্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সালিশ আইনের অনেক অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এশিয়াসহ অন্য দেশগুলো সালিশ আইনের সংশোধনী আনলেও বাংলাদেশের সালিশ আইনের কোনো সংশোধনী করা হয়নি। সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের উদ্যোগে ২০০১ সালে প্রণীত সালিশ আইনের ওপর ৫৩টি সংশোধনীর প্রস্তাব করে একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আদালতের বাইরে সালিশি কাযক্রমের মাধ্যমে বাণিজ্যিক বিরোধগুলো নিষ্পত্তির ব্যবস্থা আরও গতিশীল করতে প্রচলিত আইনটি সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত খসড়ায় সালিশি কাযক্রমে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সালিশকারীদের ফি, সালিশ ও আদালতের ক্ষেত্র, ট্রাইব্যুনালের আওতা ও নিষ্পত্তির সময়সীমা সুস্পষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি সালিশ দায়েরের পর ৩৬৫ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ ছাড়া সংশোধিত আইনে 'আদালত', 'আপিল বিভাগ', 'সালিশ', 'সালিশি ট্রাইবু্যনাল'সহ অন্যান্য বিষয়ে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও কার্যক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে প্রচলিত সালিশি ব্যবস্থা আরও গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি নাগরিকের ভোগান্তিও লাঘব করা যাবে। প্রস্তাবিত আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, সালিশি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল থাকবে। ওই ট্রাইব্যুনাল ন্যায়সঙ্গত পক্ষপাতহীনভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সালিশি পরিষদ সালিশ দায়েরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবে। তবে কোনো পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন পাওয়া গেলে নিষ্পত্তির সময়সীমা সর্বোচ্চ ৩০ দিন বাড়ানো যাবে। পক্ষদ্বয়ের মতামত ও সুবিধাজনক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সালিশের স্থান নির্ধারণ করতে হবে। এ ছাড়া সালিশি ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে পারবে এবং সাক্ষীর প্রতি সমনও জারি করতে পারবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় ১৪(ক) ধারায় সালিশকারীদের ফি-সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিচারাধীন অর্থ সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত সালিশি পরিষদের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে বিচারাধীন অর্থের ১০ শতাংশ। ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। বিচারাধীন অর্থের ৩ শতাংশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। ২ শতাংশ ফি নির্ধারিত করা হয়েছে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত। পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত বিচারাধীন অর্থের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ এবং প্রস্তাবিত খসড়ায় পাঁচ কোটি টাকার ওপরে বিচারাধীন অর্থের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে দশমিক ৫০ (আধা) শতাংশ টাকা। তবে কোনো একক সালিশকারীর ফি মূল ফির ২৫ শতাংশ বেশি হবে না বলে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে উলেস্নখ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত খসড়ায় সালিশি ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার, সালিশি চুক্তি, রোয়েদাদ ও কার্যধারা পরিসমাপ্তি, সালিশি রোয়েদাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, কিছু বিদেশি সালিশি রোয়েদাদের স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন এবং আপিলসহ নানা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান যুক্ত করা হয়েছে। যদি বর্তমান আইনের বিদ্যমান অস্পষ্টতা ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নতুন বিধান যুক্ত করে এবং পাশাপাশি আমাদের পার্শবর্তী দেশগুলোর সালিশ আইনের সংশোধনী অনুসরণ করে একটি যুগান্তকারী ও কার্যকরী সংশোধনী আনা যায় তা হলে দেশি ও বিদেশি আরও বিনিয়োগ বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা একটু ভরসা পাবে আমাদের আইনিব্যবস্থার ওপরে। পাশাপাশি সালিশ আইনের সংশোধনী কার্যকর হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা অনেকাংশে কমে আসবে। লেখক : আইনজীবী ও গবেষক, সিএম অ্যান্ড এএলসিপি ল' ফার্ম।