একখন্ড জমি ও নিষেধাজ্ঞা জারির গল্প

প্রকাশ | ০৪ জুন ২০১৯, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
কবির চৌধুরী সরকারি চাকুরে। অবসরে গিয়ে একখন্ড জমি কিনে ছোট্ট আবাসন গড়ার স্বপ্ন দেখেন। তিল তিল করে জমানো ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা দিয়ে একখন্ড জমি কেনেন। ১২ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করে আসছিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি শুনতে পেলেন একই গ্রামের জোতদার শফিক মিয়া জমিটি কিনে নিয়েছে এবং শিগগিরই তিনি তার লোকজন নিয়ে জমিটি দখল করতে আসবেন। কবির চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন জোতদার শফিক মিয়ার কাছে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন এ জমি তার বাবা কিনেছিলেন এবং শফিক তার বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে জমিটির মালিকানা লাভ করেছেন এবং এখানে কারও কোনো অধিকার নেই। কবির চৌধুরী স্পষ্ট বুঝতে পারেন শফিকের ওই জমিটিতে কোনো বৈধ স্বত্ব নেই। কিন্তু চৌধুরী সাহেব তবুও চিন্তিত কারণ শফিক সমাজের দুষ্ট শ্রেণির মানুষ। বিবাদ করাই তার স্বভাব। ভাবতে ভাবতেই তিনি শরণাপন্ন তার এক পরিচিত আইনজীবীর কাছে। আইনজীবী তার সমস্যার আইনগত সমাধান দেন। চৌধুরী সাহেবের সামনে মূলত তিনটি পথ খোলা আছে- ১। শফিক জমি দখল নিতে এলে তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন যার অধিকার আইন চৌধুরীকে দিয়েছে; ২। শফিক জমিটি যেন জোর করে দখল করে নিতে না পারে-এজন্য আদালতে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া যেতে পারে; ৩। শফিক কর্তৃক চৌধুরী সাহেব উৎখাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। বেদখল হওয়ার পর আদালতে গিয়ে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী মামলা করতে পারে। এবার জেনে নেয়া যাক নিষেধাজ্ঞা কি? আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, কোনো কিছু করা হতে মামলার পক্ষগণকে বিরত রাখা বা মামলা করার পর কোনো পক্ষের করা কাজের জন্য পরিবর্তিত কোনো সম্পত্তিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনাকে ইনজাংশন বা নিষেধাজ্ঞা বলে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার কোনো পক্ষের কর্মকান্ডে যদি মামলার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যায় বা কোনো পরিবর্তন আনা হয় তবে মামলা নিষ্পত্তির পর প্রতিকার দেয়া সম্ভব হয় না। তাই নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে মামলা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি অপরিবর্তিত রাখা যায়। অবশ্য সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের বক্তব্য না শুনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় না। করলেও এক সপ্তাহের বেশি অনিষ্পন্ন রাখা যায় না। মামলায় জড়িত কোনো পক্ষ কর্তৃক মামলা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি বিনষ্ট, ধ্বংস বা হস্তান্তর হওয়ার আশংকা দেখা দিলে অথবা কোনো ডিক্রি জারির দরুন বেআইনিভাবে বিক্রয় হওয়ার উপক্রম হলে অথবা বিবাদী তার পাওনাদারকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি অপসারিত বা হস্তান্তরিত করার ইচ্ছা প্রকাশ বা হুমকি প্রদর্শন করলে আদালত অনুরূপ কাজ রোধ করার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারেন। নিষেধাজ্ঞা প্রধানত দুই প্রকার হতে পারে। যথাক্রমে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা অনন্তকালের জন্য চলতে পারে। মামলার রায় চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার পর এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রহিম মিয়ার জমির ওপর দিয়ে আজিজ মোলস্না জোর করে রাস্তা বানাতে চায়। এখানে কখনো রাস্তা ছিল না। এই জমি পৈতৃকসূত্রে মালিক রহিম মিয়া। মামলা করে আদালত থেকে রহিম মিয়া স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেতে পারে যে, তার জমির ওপর দিয়ে রাস্তা বানানো যাবে না। মামলা চলাকালে বিবাদী যাতে মামলার বিষয়বস্তু হস্তান্তর বা কোনো প্রকার রূপান্তর ঘটাতে না পারে সেই জন্য মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিবাদীকে এই কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সাময়িকভাবে যে আদেশ দেয়া হয় তাকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলে। মামলা চলাকালে কোনো নির্দিষ্ট সময় বা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একটি সীমায়িত সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এই জন্য এই নিষেধাজ্ঞাকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলে। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার জন্য কোনো আলাদা মামলা দরকার হয় না। কোনো মামলা করা থাকলে পার্শ্ব প্রতিকার হিসেবে ইনজাংশনের দরখাস্ত দিয়ে শুনানি করে ইনজাংশন পাওয়া যায়। আদালতের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, মামলার বিষয়বস্তু বিনষ্ট বা ধ্বংসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বা বিবাদী পাওনাদারকে প্রতারণা করার উদ্দেশ্য সম্পত্তি হন্তান্তর করার ইচ্ছা বা হুমকি প্রদান করেছে তাহলে আদালত ওই বিতর্কিত বিষয়বস্তু সংরক্ষণের জন্য বাদীর বা বিবাদীর আবেদনক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারে। মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অন্যপক্ষে সুখে-শান্তিতে ভোগ-দখল করার জন্য স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দুই ধরনের হতে পারে-(ক) মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত (খ) মামলা চলাকালে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত। আজকাল আদালতে বহুল প্রচলিত 'স্টাটাস কো' এক ধরনের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বৈশিষ্ট্য ক) নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ আদালতের সুবিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। তবে এই ক্ষমতা প্রয়োগের সময় আদালতকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনতে হবে। খ) অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা একটি নৈতিকতামূলক প্রতিকার। গ) অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সম্ভাব্য অপূরণীয় ক্ষতি নিবারণমূলক ব্যবস্থা। ঘ) আদালতে বিবেচনাধীন মামলার ক্ষেত্রেই শুধু অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে। ঙ) প্রার্থিত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আবেদনকারীর কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকতে হবে। চ) নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকাকালে তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মূলনীতি ক) বাদীকে প্রাথমিকভাবে একটি কেস প্রমাণ করতে হবে। খ) নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা না-মঞ্জুর করলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। গ) বাদীর অনুকূলে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করলে তার বৃহত্তর সুবিধা হবে। লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স