তালাকপ্রাপ্ত নারীর আইনি অধিকার

প্রকাশ | ০৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
একজন স্বামী যে কোনো সময় তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। তালাকের পর তিনটি 'মাসিক কালচক্র' পূর্ণ বা ইদ্দতকালীন সময় অর্থাৎ ৯০ দিনের খোরপোশ দেয়া ছাড়া স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তবে বিধানটি ভিন্ন হবে যদি স্ত্রীর মাসিক না হয়। সে ক্ষেত্রে তিন চন্দ্রমাস পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হবে। আর ইদ্দত শেষ হলে আদালত চাইলে নারীর ভরণ-পোষণ দেয়ার জন্য সন্তান (যদি উপার্জনের ক্ষমতা থাকে), অথবা বাবা-মা, অথবা আত্মীয়-স্বজনদের আদেশ দিতে পারে। এমন কাউকে পাওয়া না গেলে সবশেষ রাষ্ট্রকে ভরণ-পোষণের জন্য আদেশ দেয়া হতে পারে। মো. হেফজুর রহমান বনাম ছামছুর নাহার বেগ এবং অন্যান্য (১৯৯৫) ১৫ বিএলডি পৃষ্ঠা ৩৪ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের একটি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, তালাক দেয়ার পরও তার তালাকপ্রাপ্ত ওই স্ত্রীর পুনর্বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য যৌক্তিক পরিমাণ অঙ্কের ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য। তবে এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ ১৯ বিএলডি পৃষ্ঠা ২৭ মামলার সিদ্ধান্তে বলেন যে, গর্ভাবস্থায় একজন তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীলোকের জন্য পরিষ্কার নির্দেশনা হলো তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সে ভরণ-পোষণ পাবে। আরেকটি মামলা রশিদ আহমেদ বনাম আনিছা খাতুন (১৯৩২) ৫৯ ইন্ডিয়ান আপিলস, পৃষ্ঠা ২১ এ আদালত বলছে, ইদ্দতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি তালাকের বিষয় স্ত্রীকে অবহিত করা না হয় সে ক্ষেত্রে তালাকের বিষয় অবহিত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী ভরণ-পোষণ পেতে অধিকারী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তালাকের পর তালাকপ্রাপ্তা নারী কোথায় যাবেন? ইসলাম ধর্মীয় বিধানানুসারে তালাকপ্রাপ্তা নারী তার বাবার বাড়িতে বা নিজগোত্রে ফিরে যাবে। আমাদের দেশের বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোতে তালাকপ্রাপ্তা নারীর বাবা জীবিত এবং সচ্ছল থাকলে নারী বাবার বাড়ি যেতে পারেন। মেয়ে বিধবা হলে বা তালাকপ্রাপ্ত হলে সে মেয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবার ওপর বর্তায়। বাবা দরিদ্র হলে সচ্ছল মায়ের ওপর এরূপ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তায় এবং মা ও বাবা উভয়ই অসমর্থ হলে দাদার ওপর এরূপ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তায়। মা-বাবা বা দাদা কেউই ভরণ-পোষণ দিতে অসামর্থ্য হলে সে ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের ওপর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তায়। এখানে নিকটাত্মীয় বলতে ওই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যার মৃতু্যর পর তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা নারী তার সম্পত্তির যে উত্তরাধিকার লাভ করত, সে অনুপাতে ভরণ-পোষণ দিতে হবে। ইদ্দত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দিন, সংখ্যা বা রজঃস্রাব গণনা করা। এটি মূলত নারীর মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা বিশেষ করে তার অনাগত সন্তানের জন্ম পরিচয়ের অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য করা হয়। কেননা এ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই জানা যায় যে নারীটি তার পূর্ববর্তী স্বামীর সন্তান গর্ভেধারণ করেন কিনা। তবে মনে রাখা দরকার যে, ইদ্দত শুধু স্বামী মারা গেলে বা বিবাহবিচ্ছেদ হলেই শুধু প্রযোজ্য। ধরুন একজন স্ত্রী গর্ভবতী হয়নি এমন অবস্থায় তার স্বামী মারা গেল। এ ক্ষেত্রে তাকে চার মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে। আর যদি তিনি গর্ভবতী থাকাবস্থায় তার স্বামী মারা যান এবং চার মাস ১০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হবে। যদি চার মাস ১০ দিন পূরণ হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম লাভ করে সে ক্ষেত্রেও তাকে চার মাস ১০ দিনই ইদ্দত পালন করতে হবে। ইদ্দতের সময় সীমা ১। বালেগা নারী অর্থাৎ পূর্ণ বয়স্ক নারী যার নিয়মিত হায়েজ হয়, তার ইদ্দতকাল তিন হায়েজ পর্যন্ত এবং হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া হলে ইদ্দতকাল হবে তার পরের পূর্ণ তিনটি হায়েজকাল। ২। অল্প বয়স্ক, বার্ধক্য, রোগব্যাধি বা অন্যকোনো কারণে কোনো নারীর হায়েজ না হলে তার মেয়াদ পূর্ণ তিন মাস। ৩। কোনো নারীর স্বামী মারা গেলে তার ইদ্দতকাল চার মাস ১০ দিন। ৪। কোনো নারীকে তালাক দেয়ার পর ইদ্দতকালে স্বামী মারা গেলে তাকে স্বামী মৃতু্যর তারিখ থেকে চার মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে। ৫। গর্ভবতী নারীর ইদ্দতকাল প্রসব হওয়া পর্যন্ত এর বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃতু্যর পর অন্তঃসত্ত্বা প্রকাশ পেলে ইদ্দতকাল হবে প্রসব পর্যন্ত। ইদ্দত কখন শুরু হয় ১। স্বামীর মৃতু্যর দিন হতে বা তালাকের ক্ষেত্রে তালাকের দিন হতে, ২। মিলন অনুষ্ঠিত না হলে ইদ্দত পালনের দরকার নেই; ৩। মৃতু্যর সংবাদ ইদ্দতের সময়কাল পেরিয়ে যাওয়ার পর তার নিকট পৌঁছলে ইদ্দত পালনের দরকার নেই। ইদ্দত চলাকালে বিবাহ ১. ইদ্দত চলাবস্থায় বিবাহ করলে সে বিবাহ অনিয়মিত বিবাহ হিসেবে গণ্য হবে। ২. সন্তান জন্ম লাভ করলে বৈধ হবে। তবে পক্ষগণের মধ্যে দায়-দায়িত্ব সীমিত হবে। ৩. স্বামী বা স্ত্রীর যে কোনো একজনের মৃতু্য হলে কেউ কারোর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে না। ইদ্দতকালে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ১। অন্য বিবাহ করতে পারে না। ২। স্বামীর যদি চারজন স্ত্রী থাকে, তাহলে তালাক ছাড়া চতুর্থ স্ত্রীর ইদ্দতকালের মধ্যে সে অন্য বিবাহ করতে পারবে না, তাকেও এই চতুর্থ স্ত্রীর ইদ্দতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ৩। স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বা তার সম্পত্তি থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে ভরণ-পোষণ আদায় করতে পারবে। ৪। সাধারণত তালাকদাতা স্ত্রী স্বামীর এবং স্বামী-স্ত্রীর উত্তরাধিকার হতে পারবে না। ৪। ইদ্দতকালে স্ত্রী নির্ধারিত মোহরানা পাবে। তলবী মোহরানা না পেয়ে থাকলে তা সত্বরই পাবে। তালাক পরবর্তী ইদ্দতকালে স্ত্রী বিয়ে করতে পারবে কিনা ১৯৮৫ সালে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য মকবুল মাজেদ বনাম সুফিয়া খাতুন (৪০ ডিএলআর ৩০৫, এইচসিডি) নামক একটি মামলা করা হয়। নিম্ন আদালত মামলাটি খারিজ করলেও উচ্চ আদালত মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে। ইদ্দতকালে স্ত্রী অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না- এ মর্মে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সুতরাং স্বামী দাম্পত্য অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য ইদ্দতকালে অন্যত্র বিয়ে না করার অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করতে পারবে। আর কেউ যদি বিয়ে করেই ফেলে আইনানুযায়ী সে বিয়ের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। এ ক্ষেত্রে নারীটিকে দ্বিতীয় স্বামী থেকে পৃথক হয়ে যেতে হবে এবং নতুন করে পূর্ণ ইদ্দত পালন করতে হবে। যদি নারীটি অন্তঃসত্ত্বা হন, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত আর অন্তঃসত্ত্বা না হলে তিনটি ঋতুস্রাব পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হবে। আর দ্বিতীয় বিয়ে যেহেতু শুদ্ধই হয়নি, তাই এ ক্ষেত্রে ইদ্দত শেষে প্রথম স্বামীর সঙ্গে ওই নারীর বিয়ে বৈধ হবে না। উলেস্নখ্য, দ্বিতীয় বিয়ের সময় নারীটির যে পরিমাণ মোহর ধার্য করা হয়েছিল, তিনি তা পাবেন না; বরং ধার্যকৃত ওই মোহর এবং মোহরে মিসিলের (অর্থাৎ নারীটির সমপর্যায়ের পিতৃবংশীয় নারীদের মোহর) মধ্যে যেটা সর্বনিম্ন ধার্য হয়েছিল সেটাই মোহর হিসেবে পাবেন। এখন দ্বিতীয় বিয়ের বিধান না হয় জানা গেল, কিন্তু ততক্ষণে যদি স্ত্রী পরের ঘরের সন্তান গর্ভে ধারণ করে তাহলে কি হবে? তখন বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৮৯-এর ২১ ধারা অনুযায়ী আগের স্বামী অথবা স্ত্রী জীবিত থাকার কারণে বিয়ে বাতিল হলেও দুই ক্ষেত্রেই (বাতিল বিয়ের কারণে) অবৈধ সন্তান শুধু পিতার কাছ থেকে বৈধ সন্তানের মতো উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাবে। ক) আগের স্বামী মারা গেছে এ সরল বিশ্বাসে বিয়ে করলে। খ) স্বামী পাগল হওয়ার কারণে বিয়ে বাতিল হয়ে গেলে। জিনিয়া কিওতিন বনাম সিতারাম মনঝি [২০০৩ (১) এসসিসি ৭৩০] নামক মামলায় বলা হয়, যদি বিয়ে বাতিল অথবা বাতিলযোগ্য হয় সন্তান শুধু বাবার কাছ থেকেই সম্পত্তি পাবে। এ তো গেল উত্তরাধিকারের কথা, কিন্তু এ অবৈধ সন্তানের দায়িত্ব নেবে কে? মূলত স্বামীকেই তখন সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। আর যদি স্ত্রী সন্তানের ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করেন তাহলে স্বামীকে দুই বছর পর্যন্ত সন্তানের খরচ স্ত্রীকে দিতে হবে। যেদিন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করছে সেদিন স্বামীর মৃতু্য হলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির নির্দিষ্ট অংশের হকদার হতে পারত। স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির প্রাপ্য অংশ লাভের পর ধর্মীয় বিধানানুসারে ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পুনরায় বিয়ে করতে পারত। লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স