উপমহাদেশে ন্যাচারাল ল' বা প্রাকৃতিক আইনের স্বরূপ

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

খাইরুল ইসলাম (তাজ)
প্রাকৃতিক আইন তত্ত্ব বা ন্যাচারাল ল' থিওরি আইনের বিকাশকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। প্রাকৃতিক আইনের অনেক মূলনীতি বিভিন্ন দেশের আইন ব্যবস্থায় সংযোজিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ভারতের আইনব্যবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক আইনি মূলনীতি ও ধারণা ইংল্যান্ড থেকে ধার করা হয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশই প্রাকৃতিক আইনের মূলনীতি। সেগুলোর কিছু উদাহরণ হলো- ন্যায়বিচার, ন্যায় এবং বিবেক, টর্ট ইত্যাদি। বাংলাদেশের আইনব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলেও আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইনের বিভিন্ন মূলনীতির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ছায়া দেখতে পাই। ভারতীয় সংবিধান প্রাকৃতিক আইনের অনেক অনেক নীতিমালাকে সংযুক্ত করেছে। এই সংবিধানে ভারতীয় জনগণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া আছে। আবার ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টকে বিশেষ একটি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই আদালত প্রশাসনিক এবং আপাত দৃষ্টির ট্রাইবু্যনালকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারসংক্রান্ত মূলনীতিগুলো ভারতীয় সংবিধানের ৩১১ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে যদি কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হয় বা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়, তখন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ বা কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে তাকে চাকরি থেকে প্রত্যাহার, অপসারণ বা অবনমন করা যাবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক আইনের ধারণাগুলো অধিক থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারতের উচ্চ আদালত বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট তাদের রায়গুলো দেয়ার ক্ষেত্রে এই মূলনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। এ কে ক্রইপক বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট দেখেছেন- প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচার নিয়মাবলির লক্ষ্য হলো ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করা অথবা ন্যায়-বিচারের অবৈধ লঙ্ঘনকে প্রতিহত করা। যদি কোনো বৈধ আইন কোনো বিষয়কে সরাসরি নির্দেশ না করে, তখন সেসব ক্ষেত্রে এই মূলনীতি কার্যকর হয়। সেগুলো দেশের আইনকে ডিঙিয়ে যায় না, বরং ওই আইনকে সহযোগিতা করে। তবে, প্রাকৃতিক আইনের ধারণাতত্ত্বও আধুনিক এবং সাম্প্রতিক সময়ে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে ধরে নেয়া হতো যে, এর মধ্যে মাত্র দুটি নিয়ম আছে- ক) কেউই নিজের কারণে নিজ কাজের বিচারক হতে পারবে না। (যেমন- গতানুগতিক বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে পুলিশ এসে বলে, খবরদার কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না); খ) কোনো পক্ষের বিরুদ্ধেই তার কথা না শুনে বা শুনানি না করে কোনো রায় বা সিদ্ধান্ত দেয়া হবে না। এরপর খুব দ্রম্নতই তৃতীয় নিয়মটি যুক্ত হয়, সেটি হলো- আপাতদৃষ্টিতে যে অনুসন্ধানগুলো করা হয়, তা অবশ্যই সরল বা সৎ বিশ্বাসে হতে হবে। যেখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব, স্বেচ্ছাচারিতা বা অযৌক্তিক কোনো বিষয়াদি আসবে না। বছরের পর বছর, অনেক ছোট ছোট নিয়মকানুন প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচার মূলনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারের উদ্দেশ্য যদি হয় ন্যায়-বিচারের লঙ্ঘনকে প্রতিরোধ করা, তবে যে কেউ একজন বুঝতে ব্যর্থ হতে পারেন যে- কেন ওই নিয়মগুলো প্রয়োগ অযোগ্য হলো এবং প্রশাসনিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলো। তবে প্রশাসনিক অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসাকে আপাতদৃষ্টির অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসা থেকে পার্থক্য করার সীমারেখা অঙ্কন করা সহজ নয়। যে অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসাগুলো প্রশাসনিক হিসেবে এক সময় বিবেচিত হতো, সেগুলো এখনকার সময়ে আপাতদৃষ্টির অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসামূলক প্রকৃতির বলে বিবেচনা করা হয়। উলেস্নখ্য, উভয় প্রকার অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসার লক্ষ্যই হলো একটি ন্যায্য বা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া। একটি প্রশাসনিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কোনো বেঠিক বা অন্যায্য সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী কার্যকারিতা অবশ্য থাকতে পারে। এই কার্যকারিতাটি আপাতদৃষ্টির অনুসন্ধানমূলক কাজের ক্ষেত্রে স্বল্প হতে পারে। প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারের নিয়মাবলি কিন্তু মূল কোনো নিয়ম নয়। কোনো বিশেষ প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারের নিয়মটি বিশেষ প্রদত্ত মামলায় প্রয়োগ হবে। তা অবশ্যই ওই মামলার ঘটনাবলি এবং পরিপ্রেক্ষিতের ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে। আরও নির্ভর করবে আইনের কাঠামোর ওপর, যার অধীনে অনুসন্ধানটি করা হয়েছিল; এবং ওই উদ্দেশ্যে যে ট্রাইবু্যনালটি গঠন করা হয়েছিল, তার ওপর। যখন আদালতের সামনে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয় যে, প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারের কিছু মূলনীতির বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে, তখন আদালতকে একটি চৌকস সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সিদ্ধান্তটি হলো- ওই নিয়ম মান্য করার বিষয়টি ওই মামলার ক্ষেত্রে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আবশ্যক বা জরুরি ছিল। একটি মামলায় দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্টের সামনে অপেক্ষারত মামলাটিতে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি কিছু কারণে স্থগিত রাখা হয়। যুক্তি দেয়া হয়, তারা প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারের লঙ্ঘন করেছে। কারণ নিয়োগ কমিটির একজন নিয়োগকর্তা নিজেই ওই নিয়োগ পছন্দে আগ্রহী ছিলেন। [এ আই আর, এস সি- ১৯৭০/১৫০] আবার, মনেকা গান্ধী বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ করে যে, প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচার একটি মহৎ মানবিকতার মূলনীতি। এর পেছনের উদ্দেশ্য হলো আইনকে সততার সঙ্গে প্রয়োগ করা এবং ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করা। অনেক বছর ধরেই, এটি খুব পরিব্যাপ্ত একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা আবার অনেক প্রশাসনিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচারের আত্মা ধরা হয় কর্মের সততাকে। এই নীতিটি গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দেয়, তা হলো- আইন নির্দেশিত পন্থা বা পদ্ধতি যদিও থাকে, তবু তা অবশ্যই সঠিক, ন্যায্য এবং সততা নির্ভর হতে হবে। [এ আই আর, ১৯৭৮, এস সি- ৫৯৭] বাংলাদেশের সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে এবং আইন সভার কিছু আইনে প্রাকৃতিক আইন এবং প্রাকৃতিক ন্যায়-বিচার মূলনীতির প্রকাশ্য এবং গুপ্ত প্রতিফলন রয়েছে। যা কিনা ভারতীয় ব্যবস্থার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। লেখক : অ্যাসোসিয়েট, দ্যা লিগ্যাল রেমেডি