পরকীয়ার সাজা নিয়ে হাইকোর্টের রুল বনাম বাস্তবতা

১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে 'অপরাধের শিকার' বিবেচনা করে আইনে সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল

প্রকাশ | ৩০ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
পরকীয়ার সাজাসংক্রান্ত দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা কেন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। রিটে ৪৯৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার আবেদনও রয়েছে। দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবে শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না। উপরন্তু স্বামী যদি কোনো বিধবা বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে পরকীয়ায় জড়িত হয় তা আইনত বৈধ। এই আইন সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটা অদ্ভুত ও বৈষম্যমূলক। এর আগে 'পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়, ইংরেজ শাসনকালে তৈরি এই আইনের ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক'- এমনটিই রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারেন না। তবে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন। ব্রিটিশদের তৈরি করা ১৮৬০ সালের আইনকে চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলার প্রেক্ষিতেই শীর্ষ আদালত এই রায় দিয়েছেন। রায়ের পর থেকেই সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ মানুষ গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশন টক শো ও পত্রিকার কলাম পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরও কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক। ১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে 'অপরাধের শিকার' বিবেচনা করে আইনে সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন জনৈক যোশেফ শাইন। তবে শীর্ষ আদালত বলেছেন, পরকীয়া সম্পর্কের কারণে জীবনসঙ্গী যদি আত্মহত্যা করেন এবং আদালতে যদি তার প্রমাণ দাখিল করা যায় তবেই এটি অপরাধে প্ররোচনা হিসেবে গণ্য হবে। অন্যদিকে সরকারি কৌঁসুলিরা 'বিয়ের পবিত্রতা' রক্ষার স্বার্থে আইনটি বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ১৯৭৯ সালের হুদুদ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী পরকীয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে মহিলাদের শাস্তির পরিমাণ বেশি রাখা হয়েছে। ফিলিপিন্সে পরকীয়া এখনো অপরাধ। স্ত্রী আর তার সঙ্গীর ৬ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে, যদি তার স্বামী প্রমাণ করতে পারেন যে, ওই পার্টনারের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রয়েছে তার স্ত্রীর। অন্যদিকে আবার স্বামীর অন্যকোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক যদি স্ত্রী প্রমাণ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে স্বামীর ১ দিন থেকে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে ৪ বছর। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবে পরকীয়াকে বিরাট অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। স্বামী বা স্ত্রী যে কারও অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা, নির্বিচার আটক, জেল, মারধর এমনকি মৃতু্যদন্ডের বিধান রয়েছে। পাঠক এবার আসল কথায় আসি। আমাদের দেশের একটি কেস স্টাডি দিয়েই শুরু করি। সুজন ও রীতার (ছদ্মনাম) দাম্পত্য জীবন ভালোই চলছিল। হঠাৎ একটি মোবাইল ফোন তাদের সুখের সংসারকে তছনছ করে দেয়। সুজনের এক বন্ধু তাকে ফোন করে জানান যে তার স্ত্রী রীতা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বসুন্ধরা সিটিতে ঘোরাফেরা করছে। ব্যবসায়ী সুজন বসুন্ধরা সিটিতে তখনই গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে থাকা ছেলেটির পরিচয় জানতে চান। এ সময় সুজনের স্ত্রী উল্টো তাকে প্রশ্ন করেন 'আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না।' সুজন রাগ সংবরণ করতে না পেরে স্ত্রীকে তখন কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। নারীর গায়ে হাত তোলার অপরাধে উপস্থিত নিরাপত্তা রক্ষীরা সুজনকে পাকড়াও করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে পুলিশের জেরায় সব সত্য প্রকাশ করেন রীতা। এসময় রীতার প্রেমিক পুলিশকে বলেন, 'রীতার সঙ্গে আমার এক বছরের সম্পর্ক। অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দিয়েছে আমার কাছে। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।' এসময় স্বামীকে না চেনার ভান করায় সুজনও রীতাকে ঘরে নিতে অস্বীকার করেন। ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ নয়! শেষমেশ রীতা সুজনের কাছে ক্ষমা চায় এবং প্রেমিক ওই পুরুষটি তাকে ভুল বুঝিয়ে এ পথে নামিয়েছে জানিয়ে তার বিচার দাবি করেন। সুজন শেষমেশ রীতার কথামতো ওই প্রেমিক পুরুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উলেস্নখ করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের স্ত্রী জানা সত্ত্বেও বা সেটা বিশ্বাস করার অনুরুপ কারণ রয়েছে এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোনো সাজা পাবে না। এ বিষয়ে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশন, ১৯৭৪ সন্নিবেশিত রয়েছে। মহিলা আসামি হতে পারে না। তবে ওই পুরুষটির সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, ওই মহিলার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার সময় আসামি জানত অথবা জানার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল যে, যৌন সঙ্গমকারী মহিলা অন্য কোনো ব্যক্তির স্ত্রী। উলেস্নখ থাকে যে, কোনো মহিলাকে তার আগের স্বামী তালাক দিয়েছেন এই সরল বিশ্বাসে আসামি বিবাহ করলে তাকে এ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে মহিলার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করা হয় সে মহিলা ওই সময় বিবাহিত না হলে এই ধারার অধীনে কোনো অপরাধ আমলে আনা যায় না। এ ধারা অধীন শাস্তি দিতে হলে বিবাহের বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হয়। তবে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট বলেছে, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না, তারা ব্যভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)। যেহেতু এ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য, অভিযুক্ত প্রেমিক পুরুষ আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের আবেদন জানান এবং বিচারক মহোদয় তাকে জামিন দেন। এ মামলায় আসামিকে সাজা দিতে হলে বাদীকে পাঁচটি বিষয় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। প্রথমত আসামি কোন নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করেছিল, দ্বিতীয়ত, ওই নারী বিবাহিত ছিল, তৃতীয়ত, আসামি বিবাহের বিষয়টি জানত এবং তা বিশ্বাস করার কারণও ছিল, চতুর্থত, ওই যৌন সঙ্গম নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে হয়েছিল, পঞ্চমত, ওই যৌন সঙ্গম নারী ধর্ষণের সামিল ছিল না। যেহেতু সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারামতে কোনো ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর। গোপাল চন্দ্র বনাম লাসমত দাসী মামলা যা ৩৪ ডিএলআর, ১৪৫ পৃষ্ঠায় উলেস্নখ রয়েছে যে, বিচার্য বিষয় সম্পর্কে যে পক্ষ কোনো ঘটনার অস্তিত্বের দাবি করে সে পক্ষই তা প্রমাণ করবে। এ মামলায় আসামি যে রীতার সঙ্গে ব্যভিচারী করেছে, বাদী সুজন প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় বিচারিক প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড, সেই সঙ্গে অর্থদন্ডেও দন্ডিত করে রায় প্রদান করেন। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স