তুষার-অদিতির ভালোবাসার বিজয় ও আমাদের বিচারব্যবস্থা

এ ক্ষেত্রে অপহরণের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলেও অপহরণের দায়ে তুষারকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেন ট্রাইবু্যনালের বিচারক। আদালত ১৪ বছর কারাদন্ড দিয়ে রায়ে বলেন, 'সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি তুষার দাস রাজ ভিকটিম সুস্মিতা ওরফে অদিতিকে অপহরণ করে নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
হিন্দুসমাজের হরিজন বর্ণের যুবক তুষার দাস আর ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে সুস্মিতা দেবনাথ অদিতি। উভয়েই একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে বাদ সাধে ব্রাহ্মণ বর্ণের সুস্মিতার পরিবার। মেয়ে নাবালিকা- এই অভিযোগ তুলে সুস্মিতার মা তুষারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন। অপহরণ ও ধর্ষণ সম্পর্কে আইনে কী বলা আছে জেনে নেয়া যাক। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অনূ্যন ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন। একই আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখায় বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতিপ্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন। প্রেম মানে না কোনো জাত-পাত, মানে না কোনো ধর্ম-বর্ণ কিংবা ধনী-গরিবের পার্থক্য। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না কোনো ভৌগোলিক সীমা কিংবা বয়সের পার্থক্য। তাই তো কোনো কোনো ভালোবাসার গল্প বেঁচে থাকে যুগ-যুগ। আবার ভালোবেসে পরিবার, পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন সমাজচু্যত বা দেশের গন্ডি পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছে বিদেশ, এমনকি নির্যাতনের শিকার হওয়ার নজিরও রয়েছে অহরহ। ভালোবেসে বিয়ে করে এরকমই করুণ পরিণতি ঘটেছে হরিজন বর্ণের যুবক তুষার দাসের জীবনে। মিথ্যা অপহরণের দায়ে ১৪ বছরের কারাদন্ড পেয়েছে তুষার দাস। আর স্বামীকে ছাড়িয়ে কাছে নিতে তিন মাসের শিশু কোলে নিয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে স্ত্রী সুস্মিতা দেবনাথ অদিতির। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, দুই বছর আগে, তুষার ও সুস্মিতা ভালোবেসে বিয়ে করেন। তিন মাস আগে তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। কিন্তু তুষার দাস ধর্মীয় বিধানে নিম্ন বর্ণের হওয়ার কারণে শুরুতেই এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি সুস্মিতার বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা। মেয়ে নাবালিকা- এই অভিযোগ তুলে সুস্মিতার মা তুষারের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন। সুস্মিতা দেবনাথ স্বেচ্ছায় তুষার দাসকে বিয়ে করার কথা বললেও তার কথা আমলে নেননি ওই আদালত। এদিকে তুষার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে হিন্দু মতে মালা বদল করে অদিতিকে বিয়ে করেন। তুষার বিচার চলাকালে আট মাস জেলহাজতে ছিল। পরে জামিন পান। অবশেষে শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে অপহরণের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলেও অপহরণের দায়ে তুষারকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেন ট্রাইবু্যনালের বিচারক। আদালত ১৪ বছর কারাদন্ড দিয়ে রায়ে বলেন, 'সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি তুষার দাস রাজ ভিকটিম সুস্মিতা ওরফে অদিতিকে অপহরণ করে নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আসামি শিশু সুস্মিতাকে বিয়ে করবেন এই আশ্বাস দিয়ে এই অপহরণ করেছেন। যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ কারণে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ড এবং অনাদায়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হলো। তবে আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে ওই দায় থেকে খালাস দিয়েছেন আদালত। বিচারক রায়ে আরও বলেন, আসামি তুষার ভিকটিমকে ধর্ষণ করেছে মর্মে চাক্ষুস সাক্ষী নেই। ভিকটিমের সঙ্গে আসামির দৈহিক মেলামেশা হয়েছিল কিনা এই মর্মে ২২ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে কোনো বক্তব্য দেননি। তবে তিনি তার জবানবন্দির শেষের দিকে বলেন, তিনি (সুস্মিতা) স্বেচ্ছায় আসামিকে বিয়ে করেছেন এবং বিয়ের পর আসামির সঙ্গে ১১ দিন ঘর-সংসার করেছেন। উভয়পক্ষের স্বীকৃত মতে গত ৩ মে ২০১৯ সুস্মিতা একটি কন্যাসন্তান জন্ম দেন। এই কন্যাসন্তানের জন্ম তারিখ পর্যালোচনা করে ধরে নেয়া যায় যে, কমপক্ষে এই কন্যাসন্তান জন্মের ১০ মাস ১০ দিন আগে সে তার মায়ের গর্ভে এসেছিল। উপরোক্ত আলোচনায় এই কথা পরিষ্কার যে, আসামি তুষার ভিকটিম সুস্মিতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। কিন্তু সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় অপরাধ কিনা রাষ্ট্রপক্ষ উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারায় তাকে ওই ধারায় সাজা দেয়া যায় না। রায় ঘোষণার পর অদিতির অনুভূতি, 'আমার একটাই অপরাধ, আমি ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে হয়ে হরিজন বর্ণের ছেলেকে ভালোবেসে বিবাহ করেছি। আইনের মারপঁ্যাচে আমাদের জীবন আজ বিপন্ন। গত ৩ জুলাই ২০১৯ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তুষার। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করেন। গত ১ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে তুষারকে জামিন প্রদান করেন। সে সময় স্বামীকে ১৪ বছরের কারাদন্ড থেকে মুক্ত করতে হাইকোর্টে ঘুরছিলেন স্ত্রী সুস্মিতা দেবনাথ। সঙ্গে ছিলেন ৮৮ দিন বয়সের শিশুসন্তান। নিম্ন আদালত তুষার-অদিতির ভালোবাসার মূল্যায়ন না করলেও উচ্চ আদালত ভুক্তভোগী এ দম্পতি ন্যায়বিচার দিয়েছে। এ রায়ের ফলে তাদের ভালোবাসার বিজয় সৃজিত হয়েছে। যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, প্রেম-ভালোবাসার মূল্যায়ন করতে জানে না, শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ঊসধরষ:ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স।