স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে

প্রকাশ | ০৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
অনেক আশা-স্বপ্ন নিয়ে দুজন মানুষ একসঙ্গে পথচলা শুরু করে। সেই পথচলা সবসময় মসৃণ হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দুজনের সম্পকর্ এমন এক অবস্থায় এসে দঁাড়ায় যাতে বিচ্ছেদই হয়ে ওঠে একমাত্র সমাধান। সিঁথি ও সুজনের (ছদ্মনাম) দাম্পত্য জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। তাদের দাম্পত্য জীবনে কোলজুড়ে আসে একটি কন্যা ও পুত্রসন্তান। কিন্তু বিচ্ছেদের পর এ সন্তানদের আইনগত অবস্থান কী হবে, তারা কার কাছে থাকবে, কে বহন করবে তাদের ভরণপোষণÑ এ নিয়ে শুরু হয় তাদের মধ্যে টানপড়েন। মুসলিম আইন অনুযায়ী, পিতাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক আর মা হচ্ছেন সন্তানের জিম্মাদার মাত্র। বিচ্ছেদ হলেও মা তার সন্তানের তত্ত¡াবধান করার ক্ষমতা হারান না। ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পযর্ন্ত এবং মেয়ে সন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পযর্ন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের মঙ্গলের জন্য যদি সন্তানকে মায়ের তত্ত¡াবধানে রাখার আরও প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে। তবে মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখার ক্ষমতা হারাতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ‘ইমামবন্দি বনাম মুসাদ্দির’ মামলায় বলা হয়েছে, ‘মুসলিম আইনে সন্তানের শরীরের ব্যাপারে লিঙ্গভেদে কিছু বয়স পযর্ন্ত মা তত্ত¡াবধানের অধিকারিণী। মা স্বাভাবিক অভিভাবক নন। একমাত্র পিতাই বা যদি তিনি মৃত হন তার নিবার্হক আইনগত বা বৈধ অভিভাবক।’ তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে মা এ অধিকার হারাবেন। [হেদায় ১৩৮, বেইলি ৪৩৫] সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূণর্ বাবার। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে ক্ষেত্রে অবশ্য মায়ের দ্বিতীয় স্বামী সন্তানের রক্ত সম্পকীর্য় নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে একজন না হলে মা তার তত্ত¡াবধানের ক্ষমতা হারাবেন [২২ ডিএলআর ৬০৮]। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূণর্, ১৬ ডিএলআর এ জোহরা বেগম বনাম মাইমুনা খাতুন মামলায় আদালত বলে, নিষিদ্ধ স্তরের বাইরে মায়ের বিয়ে হলেই মায়ের কাছ থেকে হেফাজতের অধিকার চলে যাবে না। মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বাথর্ রক্ষা হবে- সে ক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন। আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এসএমএ বকর ৩৮ ডিএলআরের মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নাবালকের কল্যাণের বিষয়টি হচ্ছে মূল কথা। আদালত নাবালকের কল্যাণ কীভাবে নিহিত আছে, সেটিই বিবেচনা করবেন। কোনো বাবা নিজের আচরণের কারণে সন্তানের তত্ত¡াবধানের অধিকার হারাতে পারেন। কোনো বাবা সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অপারগ থাকলে সে ক্ষেত্রে বাবাকে মায়ের কাছ থেকে অধিকার সমপর্ণ করা ঠিক নয়। আবার মা যদি তার নাবালক সন্তানের তার স্বামীর আথির্ক সাহায্য ছাড়াই নিজ খরচে লালন-পালন করে থাকেন, তবে সে সন্তানকে আদালত বাবার তত্ত¡াবধানে দিতে অস্বীকার করতে পারেন। [১৭ ডিএলআর ১৩৪]। যদি কোনো নাবালকের কেউ না থাকে, আদালত নিজ বিবেচনায় অভিভাবক নিয়োগ করেন। মায়ের অগোচরে যদি বাবা জোরপূবর্ক সন্তানকে নিজের হেফাজতে গ্রহণ করেন, সে ক্ষেত্রে পিতার বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা পযর্ন্ত দেয়া যাবে। এই প্রসঙ্গে, ৪৬ ডিএলআরের ‘আয়েশা খানম বনাম মেজর সাব্বির আহমেদ’ মামলার মাধ্যমে এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক সময় সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ জন্য প্রয়োজন হলে সন্তানকে আলাদা করে বিচারক নিজের কাছে নিয়ে তার মতামত জেনে নিতে পারেন। আবার মা-বাবা পযার্য়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ারও সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর ৫ ধারা মতে সন্তানের কাস্টডির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একচ্ছত্র এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের। আর কাস্টডি প্রদানের ক্ষেত্রে আদালত কী কী বিবেচনা করবেন, সেগুলো গাডির্য়ানস অ্যান্ড ওয়াডর্স অ্যাক্ট, ১৮৯০-এর ১৭ ধারায় বিস্তারিত বলা রয়েছে। ওই ধারার বিধান মতে, নাবালক-নাবালিকা যে ধমীর্য় অনুশাসনের অধীন সেই অনুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে এবং তার সাবির্ক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে আদালত অভিভাবক নিয়োগ করবেন। নাবালক-নাবালিকার কল্যাণ কী হবে, তা নিধার্রণ হবে নাবালক-নাবালিকার বয়স, লিঙ্গ, ধমর্, প্রস্তাবিত অভিভাবকের চরিত্র, সামথর্্য ও নাবালকের সঙ্গে নৈকট্য ও আত্মীয়তার সম্পকর্, মৃত মা-বাবার কোনো ইচ্ছা (যদি থাকে) এবং প্রস্তাবিত অভিভাবক নাবালক-নাবালিকার সম্পত্তির বিষয়ে সম্পকর্যুক্ত কিনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে। এ বিষয়ে নাবালক-নাবালিকার কোনো বুদ্ধিদীপ্ত মতামত থাকলে আদালত সেই মতামতকে প্রাধান্য দেবেন। মা কখন সন্তানের জিম্মাদার হারান ১. নীতিহীন জীবনযাপন করলে, ২. যদি এমন কারও সঙ্গে তার বিয়ে হয় যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনজীির্বত হয়, ৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে ও দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে, ৪. বিয়ে থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে, ৫. যদি সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধমর্ গ্রহণ করে, ৬. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেয়। সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব কার বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছেও থাকে, তবে সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূণর্ বাবার। অথার্ৎ মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা মা-বাবা আলাদা বসবাস করলে বাবাকেই সন্তানদের ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে মা আলাদা থেকেও বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা না হোক, সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করার জন্য নিদির্ষ্ট সময়ের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করে ভরণপোষণের অধিকার আদায় করতে পারেন। লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স