শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নিরাপত্তায় আইনের প্রয়োগ

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, 'শরিক রাষ্ট্রগুলো নারীকে সব ধরনের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসায়ের আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে'। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে জ্ঞানচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট অঙ্গন। এই অঙ্গন গড়ে তোলে জাতির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। পৃথিবীর যে কোনো বড় সামাজিক দায়িত্বপালন করে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলক এই শিক্ষাঙ্গন যোগ্য নাগরিক উপহার দিয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলে অপ্রিয় সত্য, কিছু কুচক্রি লোকদের কবলে শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদন্ড ভেঙে যাচ্ছে। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে আজ ছাত্রীরা কতটুকু নিরাপদে? শিক্ষকের কারণেই যদি ছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে নারীরা এগিয়ে আসছে মানুষের ভূমিকায়, আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রায় যৌন নিপীড়ন ও ইভ টিজিং বিশাল প্রতিবন্ধকতার ভূমিকা পালন করছে যা নারীশিক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রায় প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নারী নির্যাতনের সংখ্যা দ্রম্নত হারে যেন বেড়ে যাচ্ছে। আগামীতে সেই নির্যাতনের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে তা সচেতন মহল একটু ভাববেন বলে আশা করি। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতায় এসে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতিত হচ্ছে। সাধারণত আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক নারী-পুরুষের স্বাধীনভাবে চলা-ফেরা করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। নারীশিক্ষার বিষয়টি আমাদের সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে অপরিহার্য বিষয় হিসেবে জড়িত। শিক্ষা মানুষকে বাঁচতে শেখায়। অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলোকিত মানুষ গড়ার কারখানা আর শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। আর সে শিক্ষা লাভ করতে গিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথে বাঁধা দূর হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটে? আসলে সংলাপগুলো একদিক দিয়ে লজ্জাষ্কর অন্যদিক দিয়ে বেদনাদায়ক। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনগুলো অপবিত্র করতে যাচ্ছে এক শ্রেণির কুচক্রি লোক। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মহান এ পেশায় কিছু লোক ঢুকে পড়েছে, যারা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের খরব পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। দেশবাসী এসব সংবাদ দেখে, যা ছিল তাদের অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। একের পর এক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলছে। প্রতিবছর কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণে যাওয়া ছাত্রী ধর্ষিতা হয়ে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে ফিরে আসছে। অথচ এদের কাছ থেকে পরিবার যেমন অনেক কিছু আশা করে তেমনি জাতিও অনেক কিছু আশা করে থাকে। কিন্তু সে স্বপ্নকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনকে এদের কবল থেকে মুক্ত করে শিক্ষা এবং জাতির মেরুদন্ডকে শক্তিশালী করা আবশ্যক। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, 'শরিক রাষ্ট্রগুলো নারীকে সব ধরনের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসায়ের আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে'। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়। ইভ টিজিং দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৯ ধারায় দন্ডনীয় অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ১০ ধারায় যৌনপীড়ন এর শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অনূ্যন ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে এবং তার অতিরিক্ত অর্থদন্ডও রয়েছে। আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে অনধিক ৭ বছর অনূ্যন ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং তার অতিরিক্ত অর্থদন্ড। ওই আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃতু্যদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন ও আরও আধুনিকায়ন করে সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বিচার দ্রম্নত সম্পন্ন করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশকে সংশোধন ও আধুনিকায়ন করে যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের দিকনির্দেশনার অনুকরণে আইন প্রণয়ন করা। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা পরামর্শকেন্দ্র চালু করা এবং মাঝেমধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা ক্লাসের ব্যবস্থা করা। হত্যা ঘটনাকে আত্মহত্যা মামলা হিসেবে রুজু করার প্রবণতাকে কঠোরভাবে দমন করা। অধিক কর্মক্ষেত্র তৈরি করে বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সময় তার স্বভাব চরিত্র ও বংশমর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সবাইকে সচেতন থাকতে হবে যেন বজায় থাকে সমগ্র শিক্ষক জাতির সম্মান ও শ্রদ্ধা। লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।