সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব?

সড়ক দুঘর্টনায় নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হওয়ার নজির কম। আবার কখনো কখনো ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমেও মীমাংসা হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দুই পন্থায় সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করা যায়। একটি টটর্ আইনে অন্যটি মোটরযান অধ্যাদেশের অধীনে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন মারুফ আল্লাম

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮, ১১:০৪

অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের আইনে সড়ক দুঘর্টনার ঘটনাগুলোতে দায়সারা গোছের ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয় এবং এর অধিকাংশ মামলাতে আইনের দুবর্লতা কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিরা অব্যাহতি কিংবা খালাস পেয়ে যায়। ফৌজদারি মামলাগুলোতে আসামিদের সাজা হলেও ক্ষতিগ্রস্তের পরিবারের কিন্তু মানসিক প্রশান্তি ছাড়া আর কোনো লাভ হয় না। অথচ সড়ক দুঘর্টনায় যে ব্যক্তিটি নিহত হলেন, তার পরিবার যে বিপুল আথির্ক ক্ষতির শিকার হয়, সেটির ক্ষতিপূরণে কোনো মামলার প্রথা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দুই পন্থায় সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করা যায়। একটি টটর্ আইনে অন্যটি মোটরযান অধ্যাদেশের অধীনে। টটর্ আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা : আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণের জন্য টটর্ আইনে মামলা করার প্রচলন তেমন নেই। এই আইনের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে সড়ক দুঘর্টনার ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব, তবে আইনজীবীদের অনীহার কারণে তা ফলপ্রসূ হয় না। সাধারণ অথের্ ‘টটর্’ বলতে বোঝায় কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান। তাই টটর্ আইনেই সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করা আইনগত দিক থেকে ভালো। যদি কোনো ব্যক্তি সড়ক দুঘর্টনায় নিহত হন, তার পরিবার বা স্বজনরা একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামশর্ করে এই মামলা দায়ের করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দুটি মামলা হতে পারে, একটি নিহতের ঘটনায় বিচারের আজির্। অন্যটি ক্ষতিপূরণ মামলা। টটর্ আইনে দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে কোন ঘটনায় কার দায়িত্ব কতটুকু তা নিণের্য়র সুযোগ আছে। চালক কোনো ত্রæটি করলে তার দায় মালিককে নিতে হবে। কারণ মালিক তাকে সচেতন করেননি। এ জন্য মালিকই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। ভুক্তভোগীরা এ আইনে মামলা করলে ক্ষতিপূরণ পাবেনই। মামলা করার ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির পেশা, আয় ও আয়ু বিবেচনা করা হয়। অথার্ৎ একজন কমর্ক্ষম ব্যক্তি বেঁচে থাকলে কী পরিমাণ অথর্ আয় করতেন, কতদিন বঁাচতেন ইত্যাদি। তার সেই আয় দিয়ে কী কী হতো এসব তথ্য উল্লেখসহ টটর্ আইনে মামলা করা যায়। তবে টটর্ আইনে মামলার করার সমস্যা হলো: ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবিকৃত টাকার অংক বেশি হলে সেই মোতাবেক কোটর্ ফি বেশি হয়। টাকার অংকের ওপর এই ফি নিধার্রণ করা হয়। যেটি পঞ্চাশ হাজার টাকা পযর্ন্ত হতে পারে। এ কারণে অসচ্ছলদের পক্ষে ক্ষতিপূরণ মামলা করা অসম্ভব হয়ে দঁাড়ায়। এ কারণেই অনেকে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে যায় না। তা ছাড়া এ ধরনের মামলায় সময়ক্ষেপণও হয়। মামলার পর কবে নাগাদ ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা আসলে নিদির্ষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না। এ কারণেই মানুষের মধ্যে এই মামলা করার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর মামলাটি উল্লেখযোগ্য। দৈনিক সংবাদের বাতার্ সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ১৯৮৯ সালে মতিঝিলে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন। এর দুবছর পর তার স্ত্রী রওশন আরা আথির্ক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০০৫ সালে সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দেয় আদালত। পরে ২০১৪ সালে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। তবে রায় বহাল রাখলেও ক্ষতিপূরণ কমিয়ে ১ কোটি ৬৯ টাকা করা হয়। তবে ক্ষতিপূরণের সেই টাকাও এখনো আদায় হয়নি। মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে মন্টুর পরিবার। বাদীপক্ষ রায় বাস্তবায়নের জন্য যে জারি মামলা দায়ের করে। এতে আদালত বিবাদি পক্ষের সম্পত্তি ক্রোক করে। আদালত বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের তেজগঁা এলাকার জমি নিলাম করে টাকা দেয়ার নিদের্শ দিলেও তা কাযর্কর হচ্ছে না। কারণ এর পিছনে প্রভাবশালীরা জড়িত। নিলামে জমির দাম ওঠে না। বারবার নিলাম বাতিল হয়। ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে ক্ষতিপূরণের মামলা : মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১২৮ ধারায় সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্তের পরিবার জেলা জজ আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করতে পারেন। এই আইনে জেলা জজ আদালত ক্লেইম ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে তারেক মাসুদের মামলাটি উল্লেখযোগ্য। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি সড়ক দুঘর্টনায় নিহত হন চলচ্চিত্র নিমার্তা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নিবার্হী কমর্কতার্ (সিইও) মিশুক মুনীরসহ পঁাচ আরোহী। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাগামী একটি বাসের সংঘষর্ হয়। ফৌজদারি মামলা ছাড়াও ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জের জেলা জজ আদালতে মোটরযান অডির্ন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। পরে ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদের আওতায় ওই দুটি মামলার শুনানি ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার এখতিয়ার সরাসরি হাইকোটের্র আছে বলে উচ্চ আদালতে ২০১৩ সালে আরজি পেশ করলে আদালত তাদের আরজি গ্রহণ করে মামলা দুটির বিচার হাইকোটর্ বিভাগে সম্পন্ন করে। মামলায় ক্ষতিপূরণের টাকা কয়েকটি খাতে দাবি করা হয়েছিল। এক. তারেক মাসুদ তিনি সংসারের মূল উপাজর্নকারী ছিলেন; দুই. পরিবার ও সন্তানরা তার স্নেহ-ভালোবাসা হারিয়েছে তার মূল্য; তিন. ক্যাথরিন মাসুদ নিজে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তার ক্ষতিপূরণ এবং চার, ওই দুঘর্টনায় যে গাড়ি নষ্ট হয় তারও ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছিল। মামলার চ‚ড়ান্ত রায়ে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর হাইকোটর্ বিভাগ তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নিদের্শ দিয়েছে। বাসের মালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিকে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে বাসচালক ৩০ লাখ, বাস মালিক ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ এবং রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। আদালতের পযের্বক্ষণ : রায়ের পযের্বক্ষণে বলা হয়েছে, এখন থেকে সড়ক দুঘর্টনায় আহত-নিহতের পরিবার থেকে ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবেন। এতে বলা হয়, প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। দেশে ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩’ নামে একটি আইন রয়েছে। কিন্তু ওই আইন সম্পকের্ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জানত না। আদালত বলে, আইনটি সম্পকের্ (মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩) না জানার কারণে তারা (ক্ষতিগ্রস্তরা) কখনো আদালতে আসেননি। তবে এই রায়ের পর থেকে ভবিষ্যতে তাদের আদালতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলো। এখন থেকে কেউ সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতির মুখোমুখি হলে আহত ব্যক্তি তার নিজের পক্ষে অথবা নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পরিবার এই আইনের অধীনে আদালতে আসতে পারবেন। আদালত আরও বলেছে, স্নেহ-ভালোবাসা থেকে কেউ যদি বঞ্চিত হয়, তাহলে সবার জন্য একই মাপকাঠিতে ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার থাকবে। আদালতের এই নিদের্শনা এখন প্রচলিত ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি দুঘর্টনার শিকার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথও সুগম করে দিল। উল্লেখ্য, ওই আইনে সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করতে কোটর্ ফির জন্য মাত্র ২০ টাকা খরচ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত যে কেউ বা তার পরিবারের সদস্যরা এ মামলা করতে পারেন।