চেক ডিজঅনার মামলায় প্রচলিত ভুল মতবাদ

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সোহেল রানা
ভুল/অশুদ্ধ চেকের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া আসামিকে সাজা হিসাবে কারাদন্ড-জরিমানা উভয়টিই দিতে হবে; এবং জরিমানা অনাদায়ের জন্য কারাদন্ড দেয়া যাবে না। সঠিক/আইনসিদ্ধ ভুল। খোদ ১৩৮ ধারারই বিধান, সাজা হিসাবে যে কোনো একটি (কারাদন্ড অথবা জরিমানা) কিংবা উভয়দন্ড দেয়া যাবে। আর, জরিমানার হিসাবে আইনে যেহেতু 'ভরহব' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেহেতু জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ২৫ ধারানুযায়ী জরিমানা সংক্রান্ত সিআরপিসি বা দন্ডবিধি'র সব নিয়ম চেকের মামলায়ও প্রযোজ্য হবে। ফলে সাজা হিসাবে জরিমানা থাকলে অনাদায়ের পরিণতিও (কারাদন্ড) বলা থাকতে হবে। ধরি, আইনের কোনো ধারায় (যে ক্ষেত্রে সাজা হিসাবে কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয়দন্ডের সুযোগ আছে) দোষী সাব্যস্ত হওয়া আসামীকে সাজা হিসাবে শুধুমাত্র জরিমানা আরোপ করা হলো। এখন, রায়ে অনাদায়ের পরিণতি (কারাদন্ড) যদি বলা না থাকে, তাহলে রায় প্রতিপালন না করলেও কিংবা দন্ডিত-আসামী আদালতের সামনে ঘোরঘোর করলেও কিন্তু তাকে আটকানো যাবে না! এরুপ ঘটনা যাতে না ঘটে সে চিন্তা থেকেই কিন্তু আইনপ্রণেতারা জরিমানা অনাদায়ে কারাদন্ডের বিধান করে রেখেছেন। চেক ডিজঅনারের মামলায় জরিমানা অনাদায়ে কারাদন্ড দেয়া যাবে না মর্মে মতের সমর্থকগণের যুক্তি হচ্ছে, এতে কারাভোগ করেই জরিমানার দায় থেকে আসামী পার পেয়ে যাবেন। কি হাস্যকর, কি অজ্ঞতা! আইনে জরিমানা অনাদায়ে কারাদন্ডের বিধান করা হয়েছেই দন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি যাতে শারীরিকভাবে আদালতের হাতছাড়া হয়ে না যান সেটি নিশ্চিত করার জন্য। জরিমানা অনাদায়ে কারাদন্ডের ক্ষেত্রে কারাদন্ড ভোগ করলেও কিন্তু জরিমানার দায় থেকে মুক্ত হওয়া হয় না; কারাভোগটি বিবেচিত হয় জরিমানা আরোপকারী আদালতের আদেশটি স্বইচ্ছায় প্রতিপালন না করার মাশুল হিসাবে! মামলাকারীর উদ্দেশ্য বা বাস্তবতা যেটাই হোক, ১৩৮ ধারার প্রতিটি মামলার প্রকৃতি হচ্ছে 'ফৌজদারি', আর জরিমানা হচ্ছে ভরহব. চেকের প্রাপক বা বৈধ ধারক যে চেকের সমপরিমাণ টাকা আদালত থেকে তুলে নিতে পারেন তা-ও কিন্তু আদায় বা পরিশোধিত হওয়া ভরহব থেকেই, ফবপৎবব বা ধধিৎফ বা পড়সঢ়বহংধঃরড়হ থেকে নয়। কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধি দেনাদার কর্তৃক বৈধ পাওনাদারকে চেক প্রদানের মাধ্যমে প্রতারিত করা রোধ করার জন্য ১৯৯৪ সনে 'দ্য নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১' তে সপ্তদশ অধ্যায় (১৩৮-১৪১ ধারা) স্থলাভিষিক্তক্রমে যুক্ত করে তহবিল সংকটের কারণে চেক ডিজঅনারের ঘটনাকে শর্তসাপেক্ষ অপরাধ হিসাবে গণ্য করত: মামলার মাধ্যমে সাজার বিধান করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আনীত বিভিন্ন সংশোধনী, উচ্চ আদালতের কতিপয় সিদ্ধান্ত এবং চেকের মামলা গ্রহণ ও নিস্পত্তির ক্ষেত্রে আমাদের স্টেরিওটাইপ্‌ড আচরণের ফলে চেকের মামলা চেকদাতার জন্য হয়েছে মরণফাঁদতুল্য, অর্থব্যবসায়ীরা সেটিকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাচ্ছেন। বর্তমানে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পাওনাদারের যেমন সর্বাত্বক প্রচেষ্টা থাকে যেকোনো উপায়ে দেনাদারের কাছ থেকে খালি চেক সংগ্রহ করা, তেমনি অন্যায়ভাবে চেক আদায় করে মামলার মাধ্যমে মিথ্যা পাওনাদার সাজতেও অনেককে দেখা যায়। অথচ ফৌজদারি হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ দেওয়ানি মামলার চেয়েও কঠিন তামাদির বিধান এবং মামলা দায়েরের আগেই অবশ্যপালনীয় নানান শর্তযুক্ত যে সকল বিধান আইনটিতে রয়েছে তা আদালত কর্তৃক ঠিক ঠিক পালিত হলে সমাজের দুষ্ট ব্যক্তি বা অর্থব্যবসায়ীগণ মানুষদের কাছ থেকে চেক আদায় করার জন্য যে অন্যায় করে যাচ্ছেন তা এবং চেকের মামলা নিয়ে ফৌজদারি আদালতের ভিতর-বাইরে যে নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড বর্তমানে ঘটে চলছে তা অবশ্যই কমে যেত। কিন্তু বাস্তবে আমরা চলছি উল্টো পথে। আইনের স্পষ্ট বিধানকে পাশ কাটিয়ে কিংবা অগ্রাহ্য করে মনগড়া বা হাসক্যর মতবাদ গ্রহণ করছি নিজেদেরকে ঝামেলা বা পরিশ্রম থেকে বাঁচানোর জন্য। চেকের মামলা গ্রহণ বা নিস্পত্তির ক্ষেত্রে আমরা উচ্চ আদালত বা বই-লেখকদের সে সকল মতামতই লুফে নিচ্ছি যেগুলি মনগড়া, ভুল বা অকার্যকর এবং মূল আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা হয় মূল আইন পড়ছি না কিংবা পড়লেও মানছি না এবং উচ্চ আদালতের সঠিক ও সুন্দর রায়গুলি (যেমন, আলেয়া বনাম রাষ্ট্র, ৭০ ডিএলআর, ৩০৩) কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছি। (চেক ডিজঅনার নিয়ে দুই পর্বের আলোচনার আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব) চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট,কুমিলস্না।