ভালোবাসার অবমূল্যায়ন বনাম একটি নিষ্পাপ শিশুর গস্নানি

প্রকাশ | ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মাছুরা খাতুন (ছদ্মনাম)। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিকে পা দিতেই তার সব অবয়বে ফুটে ওঠে বয়স বৃদ্ধির আলামত। নিজের মেধাগুণ ও সৌন্দর্য নিয়ে সে নিজেই একটা বিপত্তির মধ্যে পড়ে। আশপাশের উঠতি বয়সি ছেলেরা তার ব্যাপারে একটু বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। মাছুরার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত এই মনোযোগ বিরক্তিকর মনে হলে একপর্যায়ে সে সুবোধ বালক সুমনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। আকর্ষণ থেকে গভীর ভালোবাসার রূপ পরিগ্রহ করে। তাদের অভিসারকে বাস্তবে চিত্রায়িত করতে একে অন্যকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বিধিবাম! বাদ সাধে মা-বাবা, অভিভাবক ও কথিত সমাজপতিরা। সব বাঁধা অতিক্রম করে তারা দুজন একই বৃন্তে ফোটার শেষ প্রান্তে ঘটে আরেক নাটকীয়তা। মাছুরাকে থামিয়ে দেওয়া হয় সুমনের সঙ্গে সম্পর্ক। মেয়ের সুখ-শান্তির বিষয় বিবেচনা করে মাছুরার পরিবার বিয়ের আয়োজন করে সরকারি চাকুরে সুজিতের সঙ্গে। মাছুরার জীবনে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। সাংসারিক সচ্ছলতা এবং স্বামী ও শ্বশুরকুলের ভালোবাসার কমতি না থাকলেও মাছুরার মনে সুমনের স্মৃতি হৃদয়ের ক্যানভাসে ভাসতে থাকে। এদিকে ব্যর্থ প্রেমিক সুমন বুকে হাজারো কষ্ট নিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে জুটিয়ে নেয় একটি চাকরি। দেখতে দেখতে কেটে যায় একটি বছর। বিদ্যোৎসাহী স্বামীর অনুপ্রেরণায় মাছুরা কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। দেখা হয় সুমনের সঙ্গে। মাছুরা পুরনো স্মৃতিময় দিনে ফিরে যান তার কল্পজগতে। সত্যি মাছুরা চলে যায় সুমনের হাত ধরে। প্রেমিক জুটির এ অভিসার গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ব্যাপক সাড়া জাগায়। কৌতূহলী মানুষের আলোচনার খোরাক হয়ে যায় এ ঘটনা। থানায় 'জিডি' করেন মাছুরার স্বামী। চলতে থাকে মাছুরার সন্ধান। খবর পৌঁছে যায় মাছুরা-সুমন জুটির কানে। পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে প্রেমিক জুটি ঘন ঘন অবস্থান বদল করতে থাকেন। এদিকে মাছুরাকে উদ্ধারের জন্য স্বামী সুজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জারি করেন 'সার্চ ওয়ারেন্ট যা বাংলায় তলস্নাশি পরোয়ানা' নামে পরিচিত। বে-আইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য তলস্নাসি ওয়ারেন্টের বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০০ ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের যদি এরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে, কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে- যা রীতিমতো অপরাধের সামিল, তাহলে তিনি একটি তলস্নাশি ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবেন। এদিকে পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই মাস। মাছুরাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে থানা পুলিশ। কিন্তু মাছুরা অন্তঃসত্ত্বা। রুজু হয় নিয়মিত মামলা। ধর্মীয় অনুযায়ী অপরের বিবাহিতা স্ত্রী তার স্বামীত্বে থাকতে আর অন্য পুরুষের জন্য বৈধ নয়। সে মারা গিয়ে অথবা তালাক দিয়ে ইদ্দতের যথা সময় অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত ওই রমণীকে বিবাহ করা হারাম। সুতরাং ওই মহিলা আসলে গম্যা, কিন্তু অপরের স্বামীত্বে থাকার জন্য সাময়িকভাবে অন্যের পক্ষে অবৈধ। এমন বিবাহিত সধবাকে কেউ বিয়ে করলেও বিবাহ-বন্ধনই হয় না। সে প্রথম স্বামীরই অধিকারভুক্ত থাকে, আর দ্বিতীয় স্বামী ব্যভিচারী হয়। দন্ডবিধি আইনের ৪৯৪ ধারায় বলা অছে, স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় আবার বিবাহ করা। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও আবার বিয়ে করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে যে প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, বিয়ের সময় পর্যন্ত সে স্বামী বা স্ত্রী যদি সাত বছর পর্যন্ত নিখোঁজ থাকেন এবং সেই ব্যক্তি বেঁচে আছেন বলে কোনো সংবাদ না পান, তাহলে এ ধারার আওতায় তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবেন না। জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। দন্ডবিধি আইনের ৪৯৫ ধারায় বলা অছে, যে ব্যক্তির সঙ্গে পরবর্তী বিবাহ হচ্ছে, তার নিকট পূর্ববর্তী বিবাহ গোপন করে তাকে বিবাহ করা। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় প্রথম বা পূর্ববর্তী বিয়ের তথ্য গোপন রাখেন, তা যদি দ্বিতীয় বিবাহিত ব্যক্তি জানতে পারেন, তাহলে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। তবে জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। দন্ডবিধি আইনের ৪৯৬ ধারায় বলা অছে, আইনত বিবাহ নয় জেনেও প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান উদযাপন করা। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি আইনসম্মত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া প্রতারণামূলকভবে বিয়ে সম্পন্ন করেন, তাহলে অপরাধী সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উলেস্নখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌনসঙ্গম করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডসহ উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে। এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। তবে জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। দন্ডবিধি আইনের ৪৯৮ ধারায় বলা অছে, অপরাধজনক উদ্দেশ্যে বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া বা আটক রাখা। অর্থাৎ কোনো বিবাহিতা নারীকে ফুসলিয়ে বা প্ররোচনার মাধ্যমে কোথাও নিয়ে যাওয়া এবং তাকে অপরাধজনক উদ্দেশ্যে আটক রাখা দন্ডবিধির ৪৯৮ ধারা অনুযায়ী অপরাধ। এ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডসহ উভয় ধরনের শাস্তি পাবেন। তবে জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ। প্রেমিক জুটি মাছুরা-সুমনের মামলা চলছে বিচারিক আদালতে। পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে দন্ডবিধির ৪৯৪ ধারায় চার্জশিট দাখিল করলেন। চার্জশিটে মাছুরার সঙ্গে সুজিতের বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল থাকা অবস্থায় তাকে সুমন বিয়ে করেছেন বলে স্পষ্ট হয়ে উঠল। বিচারিক আদালতের বিচারক মহোদয় প্রেমিক জুটির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেন। তারা উভয়েই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে বিচার প্রার্থনা করলেন। আদালতে দুটি বিবাহের কাবিননামার সার্টিফাই কপি দাখিল করলেন প্রসিকিউশন পক্ষ। দালিলিক প্রমাণ খন্ডানোর উপায় নেই। সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে বিচারক মাছুরা-সুমন উভয়কেই দোষী সাব্যস্ত করে সুমনকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও মাছুরাকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড তৎসহ উভয়কেই জরিমানা সাজা দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী এ সাজার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারামতে উচ্চ আদালতে আপিল দায়েরের শর্তে জামিনের প্রার্থনা আনয়ন করলেন। অন্তঃসত্ত্বা নারী বিবেচনায় শুধু মাছুরার জামিনের প্রার্থনা বিজ্ঞ আদালত মঞ্জুর করলেন। এরই মধ্যে মাছুরা সন্তান প্রসব করেছেন, যা সুমনের ঔরসজাত সন্তান। শিশুসন্তানকে কোলে নিয়েই প্রতিটি ধার্য তারিখে আদালতে হাজির হন মাছুরা। উলেস্নখ্য, দন্ডিত করার সময় সার্বিক মানবিক দিক বিবেচনা করে বিচারক মহোদয় মাছুরার প্রতি নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। আপিল আদালত একপর্যায়ে সুমনকে জামিনে মুক্তি দেন। কিন্তু বিধিবাম! আগের স্বামী সুজিত তাকে তালাক দিতে অস্বীকার করেন। মাছুরা হয় অনুতপ্ত। সুজিতের বিশ্বাস মানুষ ভুল করতে পারে, তাই বলে সে অস্পৃশ্য হয়ে যায় না। তার আত্মোপলব্ধি ও অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ আছে। এই আত্মোপলব্ধি ও অনুতাপের ফলে মানুষ লাভ করে মহত্ত্ব। এই পরম বিশ্বাসেই মাছুরাকে ঘরে নিয়ে যান তার বৈধ স্বামী সুজিত। প্রেমিক সুমনের ঔরসজাত সন্তানকে তার নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিতে সুজিত মোটেই আপত্তি করেনি। এরপরও ওই সন্তানের লালনপালনের ভার গ্রহণ করে মাছুরার মা-বাবা। এত কিছুর পরও ওই শিশুর পিতৃ-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ সুমন তো মাছুরার বৈধ স্বামী ছিলেন না। মাছুরার প্রথম জীবনের ভালোবাসাকে মূল্যায়ন না করা, সমাজপতিদের অদূরদর্শিতা, অন্যদিকে তাকে পরামর্শ ও প্রশ্রয়দাতাদের ভুলের কারণে সৃষ্টি হয় একটি সামাজিক সংকট। যার গস্নানি ওই নিষ্পাপ শিশুকে বয়ে বেড়াতে হবে জীবনান্তর। আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিবাহবহির্ভূত সন্তান জন্ম নেওয়াকে 'পাপের ফল' বলে অভিহিত করা হয়। সমাজের সে ছুতো ধরে নিষ্পাপ এ শিশুটিকে পাপের বোঝা মাথায় নিয়েই জীবন-জগৎকে দেখতে হবে। লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স